বিদ্যুৎ ভবনে দরপত্র নিয়ে সরকার–সমর্থকদের সংঘর্ষ : এত নিরাপত্তা, তবুও মারামারি–গুলি

রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে গতকাল দরপত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে সরকার-
সমর্থক দুই পক্ষের মারামারি হয়। পরে এক পক্ষ দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য ওই
ভবনের ভেতরে ঢুকতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দেন l ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর আবদুল গণি রোডে বিদ্যুৎ ভবনের এক পাশে সচিবালয়। উল্টোদিকে পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষ। চারদিকে নিরাপত্তা। এর মাঝেও ঠিকাদারি কাজের দরপত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার সকালে সরকার-সমর্থক দুই দলের মধ্যে মারামারি হয়েছে। এ সময় গুলিতে একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
এই মারামারি ও গুলির ঘটনা ঘটলেও সেখানে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশ সদস্যদের কোনো তৎপরতা ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দুই দলই সরকার-সমর্থক হওয়ায় পুলিশ তাঁদের ঘাঁটাতে যায়নি। তবে এ ঘটনায় সামান্য আহত হয়ে মামুন নামে এক ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে পুলিশ তাঁকে আটক করে।
জানতে চাইলে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইদুল হক ভুঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি ছিল তাৎক্ষণিক। এ ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় সামান্য আহত মামুন নামে একজনকে আটকের কথা তিনি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ঘটনার বিষয়ে কেউ থানায় অভিযোগ করেননি।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) প্রধান প্রকৌশলী দিলীপ কুমার সেন প্রথম আলোকে বলেন, ডিপিডিসির তেজগাঁও সাব-স্টেশন ভবন সম্প্রসারণের ৩৩ লাখ টাকার ঠিকাদারি কাজ ও মাদারটেক সাব-স্টেশনের সীমানাদেয়াল নির্মাণের জন্য ৪৪ লাখ টাকার কাজের দরপত্র জমার শেষ দিন ছিল গতকাল। বিদ্যুৎ ভবনের তৃতীয় তলায় দরপত্রের বাক্স রাখা ছিল। সেখানে কোনো গণ্ডগোল হয়নি। তিনি বলেন, ‘তবে আমি শুনেছি, নিচতলায় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। তা টেন্ডারের কারণে, না অন্য কারণে ঘটেছে বা কারা ঘটিয়েছে, তা আমরা জানি না।’
গতকাল দুপুরে বিদ্যুৎ ভবনে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় কয়েকটি ফুলের টব ভেঙে পড়ে রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঠিকাদার রহিম গ্রুপ ও খালিদ গ্রুপের লোকজনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও মারামারি হয়। আবদুর রহিম ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। আর খালিদ ভুঁইয়া মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
আবদুর রহিমের সঙ্গে দরপত্র জমা দিতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, রহিম তাঁর নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘শিকদার কন্সট্রাকশন্স’-এর নামে দরপত্র ফেলে নিচে নামতেই খালিদের লোকজন হামলা চালায়। উজ্জ্বল-তুহিন-সুমনের নেতৃত্বে হামলাকারীরা তাঁদের মারধর করলে তাঁরাও পাল্টা প্রতিরোধ করেন। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এর মধ্যেই গুলির শব্দ শোনা যায়। তবে এ বিষয়ে খালিদ ভুঁইয়াকে ফোন করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনের পাঁচতলা থেকে সচিবালয়ের সীমানার ভেতরে ককটেল ছুড়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। একটি ককটেল বিদ্যুৎ ভবনের পাঁচতলাতেই বিস্ফোরিত হয়। এরপর বিদ্যুৎ ভবনের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। এর মাঝেই গতকাল মারামারি ও গুলির ঘটনা ঘটে।
বিদ্যুৎ ভবনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলি
পুলিশের উপস্থিতেই বিদ্যুৎ ভবনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গুলিবর্ষণ, ককটেল নিক্ষেপ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনায় কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে আশপাশের লোকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত তিনজন। আহতদের মধ্যে আল-মামুনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাদেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ভবনে টেন্ডার জমা দেয়া নিয়ে গতকাল দুপুরে বিদ্যুৎ ভবনের দোতলায় এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) অধীনে তেজগাঁও সাব-স্টেশন ও মাদারটেক সাব-স্টেশনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের জন্য ৭০ লক্ষাধিক টাকার দুটি টেন্ডার জমা দেয়াকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই ওই এলাকায় উত্তেজনা ছিল। মদীনা গ্রুপের পক্ষে টেন্ডার জমা দেয়ার সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ পরিচয়দানকারী ১০ থেকে ১২ জন টেন্ডার জমা দিতে বাধা দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে মদিনা গ্রুপের পক্ষে কিছু যুবক তাদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে গেলে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে একপক্ষে নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়দানকারী টোকাই রফিক, রহিম ও মিজান। আর অপর পক্ষে ছিলেন যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের উপস্থিতিতেই সংঘর্ষ চলাকালে ভবনের দ্বিতীয় তলায় এবং নিচে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভবনের নিচে ও রাস্তায় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা। গুলিবর্ষণের সময় বিদ্যুৎ ভবনের দোতলায় পার্কিংয়ের সিঁড়ির কাছে থাকা বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. আহমেদ কায়কাউসের গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৬২-৩৩) গুলি লেগে গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সময় ওই প্রকল্প পরিচালকের গাড়িসহ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে সন্ত্রাসীরা। ওই সময় সচিবালয়ের পরিবহন পুল ভবনের সামনে রাস্তায় এবং সচিবালয়ের ৫নং গেটসংলগ্ন পরিবহন শাখা ভবনের সামনেও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা ফাঁকা গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় বিদ্যুৎ ভবন, সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আশপাশের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে শাহবাগ থানার অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহত আল-মামুনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে ঘটনার আগ থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মামুনসহ কয়েকজন পুলিশ। এ বিষয়ে এসআই মামুন বলেন, ঘটনার সময় আমি তৃতীয় তলায় ছিলাম। আমরা আসার পরে গুলিবর্ষণ হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু কে বা কারা গুলিবর্ষণ করেছে এ বিষয়ে পুলিশের কাছে কোন তথ্য নেই বলে জানান তিনি। তবে আহত আল-মামুন ছাত্রলীগকর্মী বলে স্বীকার করেন ওই এসআই। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন কিন্তু অতিরিক্ত পুলিশ আসার আগেই পালিয়ে যায় তারা। সূত্র মতে, মদিনা গ্রুপের টেন্ডার জমা দেয়ার আগে ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণাধীন তানভীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তানভীর গ্রুপ ও তালুকদার কনস্ট্রাকশনের দুটি এবং মাহবুব আলম কনস্ট্রাকশনের একটি টেন্ডার জমা দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) অধীনে তেজগাঁও সাব-স্টেশন ও মাদারটেক সাব-স্টেশনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের দুটি টেন্ডার জমার শেষদিন ছিল গতকাল। এর একটি ৪২ লাখ ও অপরটি ৩১ লাখ টাকার কাজ বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক শেখ রাসেল বলেন, ছাত্রলীগ টেন্ডারবাজিতে বিশ্বাস করে না। বিদ্যুৎ ভবনের ঘটনায় ছাত্রলীগ জড়িত কিনা এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই।

No comments

Powered by Blogger.