রাজনৈতিক অস্থিরতায় পঙ্গু হচ্ছে অর্থনীতি

বাংলাদেশের নাম শুনলেই কানাডার মানুষের কেবল দেশটির পোশাক শিল্প ও এর ট্র্যাজেডির কথা মাথায় আসে। এছাড়া, অনেকের হয়তো সামপ্রতিক লঞ্চ দুর্ঘটনার কথা মনে পড়বে, যেখানে নিহত হন ৭৫ জন। তবে বাংলাদেশ সমপর্কে বেশির ভাগ কানাডিয়ান যা জানেন না, তা হলো, বাংলাদেশে এখন চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, যা দেশটিকে ক্রমেই পঙ্গু করে তুলছে। বাংলাদেশের সামপ্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে এমনটিই মন্তব্য করা হয়েছে কানাডার অন্যতম পত্রিকা দ্যা গ্লোব অ্যান্ড মেইলের একটি মতামত কলামে। ‘বাংলাদেশ অন দ্য ব্রিংক: হোয়্যাট ইট মিনস ফর কানাডা’ শীর্ষক ওই মতামত কলামে আরও বলা হয়েছে, প্রায় ২ মাস আগে, বর্তমান সরকারের বৈধতার প্রশ্নে শুরু হয় আন্দোলন। এর ফলে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে শুরু হয় নতুন আন্দোলন। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিরোধী দলগুলো। পেট্রলবোমা হামলা ও বিরোধী নেতাদের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে প্রায় হাজার হাজার বিরোধী কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত বৃহসপতিবার হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান ইসলাম-বিরোধী ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। বর্তমান সমস্যা কেন্দ্রীভূত রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দল বিএনপি’র প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে চলা বহু বছরের বিরোধের মধ্যে। প্রায় ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রয়েছেন এ দুই নেত্রী। বাংলাদেশের রাজনীতি সব সময়ই ছিল রক্তাক্ত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন ও স্বাধীনতার নেতা এবং দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৫ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য সহ হত্যা করা হয় তাকে। অপরদিকে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। জিয়াউর রহমানও একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। বিরোধীদের প্রধান উদ্বেগ, বিরোধীদের প্রতি দমননীতি প্রয়োগ করে শেখ হাসিনা বস্তুত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। ঐতিহাসিকভাবে দেশটির সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে, যদিও ব্যতিক্রম ছিল একটি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনা হস্তক্ষেপের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু আশা রয়েছে যে, এ ধরনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠার আগেই পরিস্থিতি শান্ত হবে। বাংলাদেশকে কানাডার গুরুত্ব দেয়া উচিত দুইটি মূল কারণে। প্রথমত, বাংলাদেশ ভারত বা চীনের মতো অর্থনৈতিকভাবে অতটা শক্তিশালী নয়। পাকিস্তান বা ইরানের মতো নিরাপত্তাগত কারণে ঝুঁকিপূর্ণও নয়। তবে পরিস্থিতি শান্ত হলে, ইসলাম ও গণতান্ত্রিক নাগরিক সমাজ পাশাপাশি থাকতে পারে- এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক উদাহরণ হয়ে উঠবে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম দেশ। মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, এমনকি উপজাতিদের ধর্মকেও বাঙালি সমাজে স্বাগত জানানো হয়। ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ে সাধারণ বিষয়। এছাড়া হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, ইসলামী সহিংসতার অস্তিত্ব নেই। দেশটিতে ইসলামপন্থিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যাবে না, তবে তারা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাদের বিরোধীদের সংখ্যা প্রচুর ও সোচ্চার। ১৯৭১ সালে ভাষা, গণতন্ত্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ। চরম দারিদ্র্য ও গভীর রাজনৈতিক সমস্যায় ভুগছে দেশটি। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মতো মৌলবাদ এ দেশে অনুপস্থিত, যদিও বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র সঙ্গে জোটবদ্ধ রয়েছে দেশটির প্রধান ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু দলটি সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে, প্রভাবও অনেক কম। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল দেশ ও কানাডার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সহযোগী। ফলে আসছে বছরগুলোতে দেশটির আর্থিক ও মানবিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। ২০০৩ সালে কানাডার সঙ্গে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই দেশের বাণিজ্য চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৩ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০১৩ সালে এ বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯০ কোটি ডলারে। কানাডা কৃষিজাত খাদ্য, ধাতু, ইলেক্ট্রনিক্স ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রপ্তানি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে কানাডা আমদানি করে মূলত তৈরী পোশাক। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। যদিও সামপ্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া, কানাডার সর্বোচ্চ উন্নয়ন সহযোগিতা পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই রয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে কানাডা ‘কান্ট্রি অফ ফোকাস’-এ অন্তর্ভুক্ত করে। কানাডা বাংলাদেশের তরুণ ও নারীদের জন্য অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সুযোগ বৃদ্ধির আশা করে। দেশটির শিক্ষার হার কম, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীও কম, দুর্নীতি খুব বেশি, তবে প্রায় ৩৬ শতাংশ জনগণই ১৫ বছরের নিচে। এছাড়াও ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বাংলাদেশই বিশ্বের সামনে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিল, যার মাধ্যমে লাখো মানুষ দরিদ্রতার কষাঘাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। এটি একটি প্রমাণ যে, দেশটি তার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারবে। বাংলাদেশের জনগণের বিশাল অংশই দরিদ্র। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৭টি দেশের মধ্যে দেশটির অবস্থান ১৪৬তম।
প্রায় ৩০ শতাংশ জনগণ দৈনিক ১.২৫ ডলারের (১০০ টাকা) কম আয় করে। তবে মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস-এ বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে, বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে। গড়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৬ শতাংশ করে, যা ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় সামান্য কম। এছাড়া, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দরিদ্রতার হার উভয়ই ক্রমে কমছে। ‘ব্যাটলিং বেগমস’ (কোন্দলরত দুই বেগম) নামে পরিচিত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অধীনে বাংলাদেশ হয়তো এরকম রাজনৈতিক সহিংসতা আরও দেখতে পাবে। তবে যখন সহিংসতা থামবে, অর্থনৈতিক ভিত্তির শক্তিশালীকরণে ও আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধিতে কানাডার একটি আদর্শ অংশীদার হয়েই থাকবে বাংলাদেশ। এছাড়াও শিক্ষিত, শক্তিশালী, মুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ একটি মুসলিম দেশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.