গরমের আগেই ঢাকায় পানির সংকট by অরূপ দত্ত

(খাওয়ার পানির তীব্র সংকট চলছে রাজধানীর খিলগাঁও, রাজারবাগ ও বাসাবো এলাকায়। পানির পাম্পে গভীর রাত পর্যন্ত পানি সংগ্রহের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে। ছবিটি বাসাবোর কদমতলা পানির পাম্প থেকে তোলা l প্রথম আলো ) প্রজ্ঞার স্কুল ছুটি হবে সকাল সাড়ে নয়টায়। আধা ঘণ্টাও বাকি নেই। রাজধানীর মিরপুরের বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী প্রজ্ঞাকে আনতে যাবেন মা রীতা দেবনাথ। কিন্তু তিনি পড়েছেন দোটানায়। এক্ষুনি পানি চলে যাবে, পানি ধরে না রাখলে চলবে না। আবার মেয়েও তাঁর অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত কিছুটা পানি ধরে ছুটলেন মেয়েকে আনতে। মিরপুর ১৪ নম্বরের বাসিন্দা রীতা দেবনাথ গত সোমবার এসব কথা জানিয়ে বললেন, প্রায় এক মাস ধরে তাঁর এই অবস্থা চলছে। মিরপুর ১৪ নম্বরসহ কাফরুল থানা এলাকার প্রায় পুরোটাতেই এক মাস ধরে চলছে পানির সমস্যা। তিনি জানান, সকালে ও বিকেলে দুই বেলা কিছু সময়ের জন্য পানি আসে। ওই সময় পানি ধরে রাখতে প্রতিদিনই তাঁর মতো এলাকার অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন।
কেবল মিরপুর ও কাফরুল নয়, গরম পড়তে না-পড়তেই রাজধানীর অনেক এলাকায় পানির সমস্যা শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম কামরুল আলম চৌধুরীও জানিয়েছেন, গরম বাড়ায় রাজধানীর কোথাও কোথাও পানির সমস্যা চলছে। তবে তা এখনো বড় কোনো সংকট নয়। যে গন্ধ আসছে, তা পানি শোধন করার জন্য ব্যবহৃত ক্লোরিনের।
ঢাকার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা বাসাবো, গোড়ানসহ আশপাশের এলাকায়ও দিন পনেরো ধরে পানির কষ্ট চলছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, নূরবাগ এলাকায় গভীর নলকূপে (পাম্প) পানির উৎপাদন কমে গেছে।
সোমবার দুপুর ১২টার দিকে বাসাবো বৌদ্ধমন্দিরের কাছে কদমতলা গভীর নলকূপ ঘিরে দেখা গেল অনেক মানুষের ভিড়। ১০-১২ বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধ—সব বয়সের নারী-পুরুষ সেখান থেকে পানি সংগ্রহে ব্যস্ত। হাঁড়ি-কলস, বিভিন্ন ধরনের জারিকেনের দীর্ঘ সারি। গভীর নলকূপ থেকে উত্তোলিত পানি পাইপলাইনে ঢোকার আগে মোটামুটি বিশুদ্ধ থাকে। তাই ওয়াসার পাম্প থেকে পানি নিলে তুলনামূলক বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় বলে এখানে এমন ভিড়।
সেখানে পানি নিতে আসা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মো. হায়াত আলী জানান, বাসায় ওয়াসার যে পানি আসে, তাতে দুর্গন্ধ। তাই প্রতিদিন এখান থেকে পানি নেওয়া অবসরজীবনে তাঁর চাকরি হয়ে গেছে।
পানি নিতে ছোট গৃহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে আসা জাহানারা বেগম বলেন, বাসায় যে পানি আসে, তা পান করে তাঁর পরিবারের সদস্যারা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তাই তিনি এখান থেকে বিশুদ্ধ পানি নিতে এসেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মোশাররফ হোসেন বলেন, বছরের পর বছর দেখছি পানির এই সমস্যা। এটা হয়তো এলাকাবাসীর জন্য নিয়তিই হয়ে গেছে।
কিন্তু ওই সময় বৌদ্ধমন্দিরের পানির পাম্পটি বন্ধ ছিল। জানা গেল, দুপুরে পাম্পটি বন্ধ থাকে, বিকেলে খুলে দেওয়া হয়। সেই বিকেলে পানি পাওয়ার জন্য ভরদুপুরেই সেখানে এমন ভিড়। সেখানে আসা কয়েকজন জানান, এখান থেকে এলাকার অসংখ্য বাসিন্দা পানি নেন।
সকালে পানির জন্য ভিড় দেখা যায় গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে। এখানে পানি সংগ্রহে এসেছেন গোপীবাগ, পেয়াদাপাড়া, অভয় দাস লেনসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। পেয়াদাপাড়ার বাসিন্দা সাহেব আলী অভিযোগ করেন, এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যারা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারছে। পানি সংগ্রহ করতে বড় বড় পাত্র নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনসহ পাম্প হাউসগুলোতে ছুটছেন প্রায় প্রতিটি বাড়ির মানুষ। বাসায় ওয়াসার যে পানি পাওয়া যায়, তাতে থাকে একধরনের ঝাঁজ, ওই পানি ফুটিয়ে পান করলেও ঝাঁজ যায় না। ওই এলাকার বালুর মাঠে স্থাপিত পাম্প থেকেও মানুষ পানি সংগ্রহ করে। তবে গতকাল ওই পাম্প বন্ধ ছিল। এ কারণে রামকৃষ্ণ মিশনে ভিড় বেড়েছে।
পানিতে ঝাঁজ থাকার অভিযোগ নগরের আরও কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদেরও। কাঁঠালবাগানের একজন গৃহিণী দীপিকা সিংহ বলেন, কলের পানি পান করা দূরে থাক, চোখ ধুলেও জ্বালা করে। নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকায় পানির সঙ্গে ময়লা, মাটি আসে। থাকে দুর্গন্ধ।
মিরপুরের বিভিন্ন সেকশন, উত্তরা ৪ ও ১২ নম্বর সেক্টর প্রভৃতি এলাকায়ও পানির সমস্যা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা। ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, সমস্যা কমাতে গোড়ান, বাসাবো, কাফরুল, মিরপুর, উত্তরাসহ নগরের বিভিন্ন স্থানে ১২টির মতো গভীর নলকূপ (নতুন ও প্রতিস্থাপিত) বসানো হচ্ছে।
বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার ৬৮০টি গভীর নলকূপ থেকে পানি উত্তোলিত হচ্ছে, যা মোট উৎপাদনের ৭৮ শতাংশ। সায়েদাবাদসহ তিনটি পানি শোধনাগার থেকে বাকি ২২ শতাংশ পানি আসছে। সোমবার মোট ২১৭ কোটি লিটার পানির উৎপাদন হয়েছে বলে ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান।

No comments

Powered by Blogger.