দলীয় পরিচয়ের বলি হবেন মেয়ররা? by আবদুল লতিফ মন্ডল

‘সরিয়ে দেয়া হচ্ছে বিএনপির মেয়রদের’ শিরোনামে ১ মার্চ একটি দৈনিকের (প্রথম আলো) প্রথম পৃষ্ঠায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একের পর এক মামলায় জড়িয়ে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে বিএনপি’র নির্বাচিত মেয়রদের। ইতিমধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের গ্রেফতারকৃত মেয়র এমএ মান্নানের স্থলে যে কোনো মুহূর্তে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমানকে। নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার কারণে পলাতক রয়েছেন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. মনিরুজ্জামান অসুস্থতার কারণে প্রায় এক মাস ধরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের জুনে রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল এবং পরের মাসে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়। পাঁচটিতেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবরোধ-হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দিয়ে নির্বাচিত মেয়রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ফলে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। এ সুযোগে তাদের জায়গায় ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্যানেল মেয়রের তালিকায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯-এ মেয়রকে সাময়িক বরখাস্তকরণ ও অপসারণের শর্তাবলী বিধৃত হয়েছে। সরকার কোনো সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবেন যদি তাকে অপসারণের জন্য আইনটির ১৩ ধারার অধীনে কার্যক্রম শুরু করা হয়ে থাকে অথবা তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়ে থাকে। সরকার কোনো মেয়রকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ প্রদান করলে ওই আদেশপ্রাপ্তির তিন দিনের মধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্তকৃত মেয়র তার দায়িত্ব জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে মেয়র প্যানেলের সদস্যের কাছে হস্তান্তর করবেন এবং ওই মেয়রের বিরুদ্ধে আনীত কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত অথবা তিনি অপসারিত হলে তার পরিবর্তে নতুন মেয়র নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত মেয়র পদের দায়িত্ব পালন করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র (ধারা ১২)।
যেসব কারণে সরকার কোনো সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করতে পারবে, সেসবের মধ্যে রয়েছে- (ক) যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে সিটি কর্পোরেশনের পরপর তিনটি সভায় অনুপস্থিতি; (খ) নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্তি; (গ) দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা; (ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত; (ঙ) আইনানুযায়ী নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত; (চ) বার্ষিক ১২টি মাসিক সভার কমপক্ষে ৯টি সভা গ্রহণযোগ্য কারণ ব্যতীত অনুষ্ঠান করতে বা ক্ষেত্র মতে, ওই সব সভায় উপস্থিত থাকতে ব্যর্থতা (ধারা ১৩)।
‘অসদাচরণ’-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘অসদাচরণ’ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনের বিধি-নিষেধ পরিপন্থী কার্যাদি, দুর্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য তথ্য প্রদান করাকে বোঝাবে।
শুধু সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে নয়, স্থানীয় সরকারের সব প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণ ক্ষমতা সরকার নিজের হাতে রেখেছে। যেমন- জেলা পরিষদ আইনের ১০ ধারায় চেয়ারম্যান ও নির্বাচিত সদস্যদের অপসারণের ক্ষমতা, উপজেলা পরিষদ আইনের ১৩ ধারায় চেয়ারম্যান ও নির্বাচিত মহিলা সদস্যদের অপসারণের ক্ষমতা এবং ইউনিয়ন পরিষদ আইনের ১২ ধারায় চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়েছে।
দেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাস সুখকর নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রার শুরুতেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হোঁচট খায়। ১৯৭২ সালে জারিকৃত রাষ্ট্রপতির ৭নং আদেশ দ্বারা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যমান সব স্থানীয় সরকার কমিটি ভেঙে দেয়। তাছাড়া ওই সরকারের সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী দ্বারা প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিধান বিলুপ্ত করা হয়। ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সাময়িকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় কিছুটা আশার আলো দেখা দেয়। স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার তিন ধরনের স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করে। এগুলো হল- ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ। ১৯৮২ সালে ক্ষমতায় এসে জেনারেল এইচএম এরশাদ থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করেন। আইনে জনগণের সরাসরি ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান করা হয়। ১৯৯০ সালে দ্বিতীয়বার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক হিংসার বশবর্তী হয়ে বিএনপি সরকার উপজেলা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে। জনগণের সরাসরি ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান করা হলেও ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকার প্রবর্তিত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। অবশ্য এরশাদ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জেলা পরিষদও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ পাস করলেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৮ সালের উপজেলা আইন বাতিল করে স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ ২০০৮ জারি করে। এতে জনগণের ভোটে একজন চেয়ারম্যান ও দু’জন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান করা হয়। তাছাড়া ১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ আইনে সংসদ সদস্যের উপজেলা পরিষদে উপদেষ্টা হওয়ার এবং তার পরামর্শ গ্রহণ করার যে বিধান ছিল তা বিলুপ্ত করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ ২০০৮ বাতিল করে ১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ আইনটি পুনঃপ্রচলন করে। এতে সংসদ সদস্য উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হওয়ায় এবং তার পরামর্শ মেনে চলা পরিষদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়ায় পরিষদের কাজের ওপর সংসদ সদস্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরিষদ হারায় তার স্বাধীনতা। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সমিতি সংসদ সদস্যকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করার বিধানটি বাতিলের জন্য অনেকদিন ধরে দাবি করে আসছে। তবে সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এরশাদ সরকার প্রবর্তিত জেলা পরিষদ ওই সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার জেলা পরিষদ আইন ২০০০ পাস করলেও ওই মেয়াদে আইনটি বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী বিধিমালা প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি বাদে অন্য ৬১টি জেলার জেলা পরিষদে দলীয় ব্যক্তিদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। জেলা পরিষদ আইন ২০০০-এ জেলা পরিষদে নির্বাচনের বিধান থাকলেও প্রত্যাশিত নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
উপর্যুক্ত বর্ণনার উদ্দেশ্য হল এটা বলা যে, আসলে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে কোনো সরকারই চায়নি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হোক এবং স্বাধীনভাবে কাজ করুক। মুখে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ ও স্বনির্ভরতার কথা বলা হলেও তারা আসলে চেয়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের সম্প্রসারিত অঙ্গ হিসেবে কাজ করুক। ক্ষমতাসীন সরকারও একই ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনগুলোতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সে ব্যবস্থাই নিশ্চিত করা হয়েছে।
এখন সরকারবিরোধী দল বিএনপি থেকে নির্বাচিত মেয়রদের অপসারণ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। একমাত্র সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ছাড়া উপর্যুক্ত অন্য মেয়রদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানা যায়নি। গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানা যায়, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী একটি খুনের মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয়েছেন। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী অবরোধ-হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দিয়ে উপর্যুক্ত নির্বাচিত মেয়রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মেয়রদের বিরুদ্ধে ‘ক্রিমিনাল কেসের’ কথা বলেছেন। সেক্ষেত্রে অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হলেই তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে প্যানেল মেয়রকে দায়িত্ব প্রদান করা সমীচীন হবে। আইনটিতে সে রকমই বলা আছে। তা না হলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সরকারবিরোধী দল বিএনপির নির্বাচিত মেয়রদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জনমনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাবে। তাছাড়া এটি ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির সৃষ্টি করবে। ভবিষ্যতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন হলে নতুন দলীয় সরকার এ নজির অনুসরণে উদ্যোগ নিতে পারে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.