কে নেবে দায়ভার by আতাউর রহমান ও বিপ্লব চক্রবর্তী

চাঁদের মতো মিষ্টি মুখখানি। গায়ে নীল গেঞ্জি। পায়ে গোলাপি রঙের জুতা। ১৪ মাসের ছোট্ট শিশুটি যেন ঘুমিয়ে আছে। নাম রাইসান। আদরের ছোট্ট নাতিকে কোলে তুলে বারবার পাগলের মতো স্নেহময়ী চুমো খাচ্ছিলেন রাইসানের দাদি রিক্তা বেগম। তবু ঘুম ভাঙে না শিশুটির। এর পরই দাদির বিলাপ, 'দাদু রে, কোথায় হারিয়ে গেলি? কোথায় পালালি? তুই কি আর জাগবি না? দাদু বলে আমায় কে ডাকবে। চোখ তুলে দাদুর দিকে তাকাও।' গতকাল সোমবার পদ্মাপাড়ের বাতাসে কান পাতলে দিনভর ভেসে আসছিল স্বজনহারা মানুষের আহাজারি। কেউ করছিলেন নীরব অশ্রুপাত। তবে বাঁধভাঙা সেই শোকের অশ্রুতে যেন স্বজনহারা মানুষের বেদনার কাব্যই দীর্ঘ হচ্ছিল। এখন পর্যন্ত পদ্মা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারালেন ৭১ জন। রোববার দুপুরে লঞ্চডুবির পর গতকাল সকাল ১০টায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ২২ ঘণ্টার উদ্ধার অভিযানের পর এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্বজনদের দাবি।
গতকাল দুর্ঘটনাস্থলে বারবারই ঘুরেফিরে এসেছে একটি প্রশ্ন, কার বা কাদের কারণে ঝরে গেল এসব প্রাণ। কে নেবে এর দায়ভার। এভাবে আর কত লাশ যাবে পদ্মায়-মেঘনায়। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস বলেন, 'চালকদের অদক্ষতা আর প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এটা কখনোই কাম্য নয়। তারা সতর্ক ছিলেন না। দুই চালকই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। তবে পুরো বিষয়টি পৃথক তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে। এর আগে রোববার ঘটনাস্থলে গিয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানও একই ধরনের কথা বলেছেন।
এদিকে, পদ্মায় লঞ্চডুবিতে নিহতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল তিনি টুইটারের মাধ্যমে এক শোকবার্তায় নিহতদের পরিবারের স্বজনের প্রতি সমবেদনা জানান। এ ছাড়া এক শোকবার্তায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান। শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডবি্লউ গিবসনও।
রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে যাওয়া এমভি মোস্তফা নামে পদ্মা নদীতে যাত্রী পারাপারের লঞ্চটি অন্য একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায়। এর পর রোববার গভীর রাত পর্যন্ত ৪১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল ভোররাত সাড়ে ৪টার দিকে লঞ্চটি টেনে তোলার পর ভেতরে পাওয়া যায় আরও ২৯ জনের মরদেহ। নিহতদের মধ্যে পুরুষ ২৭ জন, নারী ২৪ ও শিশু ২০ জন। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও এক নারীর পরিচয় শনাক্ত হয়নি। তার মরদেহ ঢামেক মর্গে রয়েছে। গতকাল রাত ১০টার দিকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে ভাটির ৬ কিলোমিটার দূরে মান্দারখোলা এলাকায় এক শিশুর লাশ পাওয়া যায় বলে জানান শিবালয় উপজেলার নির্বাহী কমকর্তা এ কে এম গালিব খান। লঞ্চটি টেনে পদ্মার তীরে নেওয়ার পর গতকাল সকাল ১০টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে লাশের অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
শিশু রাইসানকে কোলে নিয়ে দাদি রিক্তা বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, রাইসান তার মা আর বোনের সঙ্গে গাজীপুর থেকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সাওতা গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিল... এ কথা বলেই রিক্তা ভেঙে পড়েন কান্নায়। রাইসানের বাবা ফারুক হোসেন জানান, সকালে ছেলে রাইসান, ১৪ বছরের মেয়ে বীথি আর তার স্ত্রী রেবেকাকে লঞ্চে তুলে দেন। সঙ্গে তার বৃদ্ধ চাচা গোলাম মোস্তফাও ছিলেন। লঞ্চডুবির পর সন্ধ্যায় স্ত্রী, মেয়ে আর চাচার লাশ পান। তাদের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে খুঁজছিলেন ছেলেটাকে। তীর থেকে মাঝনদী পর্যন্ত কোথায়ও খুঁজে পাননি। অবশেষে ছেলেকে পেলেও সে কোনো কথা বলে না। শোকে পাথর হয়ে যাওয়া ফারুক তথ্যগুলো দিতে দিতে একপর্যায়ে বিলাপ করতে থাকেন। স্ত্রী, আদরের মেয়ে, ছেলে আর চাচাকে হারিয়ে অনেকটা পাগলের মতোই আচরণ করেন পেশায় মুদি দোকানি ফারুক।
বডিব্যাগে মোড়ানো একেকটা মানুষের মরদেহ নিয়ে সেখানে ঢুকতে থাকেন স্বেচ্ছাসেবকরা। মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানে ২৯টি মরদেহ নেওয়া হয় সেখানে। আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়েন নিশ্চিত দুঃসংবাদের প্রতীক্ষায় থাকা স্বজনরা। সারি সারি লাশ উল্টেপাল্টে খুঁজতে থাকেন নিজের স্বজনকে। ভোররাতে কান্না আর গগনবিদারী আর্তনাদে ভারি হয় পাটুরিয়ার চারপাশ। পাটুরিয়া লঞ্চঘাট ছাড়াও মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরাসহ কয়েকটি জেলার পরিবেশ শোকাবহ। ডুবে যাওয়া লঞ্চে মূলত এসব এলাকার বাসিন্দাই বেশি ছিলেন। গতকাল পাটুরিয়া লঞ্চঘাটের পাশে নির্বাক হয়ে বসেছিলেন পুলিশ কনস্টেবল নুরুল ইসলাম। তিনি মানিকগঞ্জ জেলার গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত। লঞ্চডুবির ঘটনায় তার মুখের সব ভাষা বন্ধ হয়ে গেছে, কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। লঞ্চডুবির পর কনস্টেবল নুরুল ইসলামের স্ত্রী রুমা বেগম, সাত বছরের ছেলে উৎসব আর আড়াই বছরের ছেলে উৎসের লাশ মিলেছে।
নুরুল ইসলামের শ্যালক মুনসুর আলী শেখ জানান, তার বোন ও ভাগ্নেরা মানিকগঞ্জে ভাড়া থাকত। তবে রোববার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীতে যাওয়ার জন্য দুলাভাই নিজেই দুই ছেলে আর স্ত্রীকে লঞ্চে তুলে দিয়েছিলেন। এর আধাঘণ্টা পরই খবর পান দুর্ঘটনার। ভোররাতে লঞ্চ উদ্ধারের পর পাওয়া যায় বোন আর দুই ভাগ্নের লাশ।
গতকাল দুপুরে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে স্বামী লিটন মিয়ার (৩০) লাশের পাশে বসে কাঁদছিলেন মারুফা বেগম। আর নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে অতি যত্নে মুছে দিচ্ছিলেন নিথর দেহের মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি। বিলাপ করে মারুফা বলছিলেন, তার স্বামী ঢাকায় স্কুলভ্যান চালাতেন। তাদের সংসারে দুটি মেয়ে রয়েছে। সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন তার স্বামী। সাভারের নবীনগরের বাসিন্দা বিউটি পারভীন রাতভর কান্নায় পদ্মার তীর ভারি করলেও গতকাল সকালে জানালেন, তার একমাত্র মেয়ে কেয়ামণির লাশটি পেয়েছেন। সাত বছরের কেয়ামণির লাশ পেলেও বিউটির মা আনোয়ারা বেগম তখনও নিখোঁজ। রাতভর বিলাপের পর শোকে পাথর বিউটি জানান, নানি ও নাতনি মিলে নড়াইলে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিল। এরপরই সব শেষ।
রাতভর উদ্ধার অভিযান :রোববার দুপুর ১২টার দিকে পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া এমভি মোস্তফা ডুবে যাওয়ার পর প্রথমে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। এর পর চার ডুবুরি নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২৫ সদস্যসহ, নৌ পুলিশ, নৌবাহিনী ও বিআইডবি্লউটিএর উদ্ধারকর্মীরা কাজে যোগ দেন। রাত সোয়া ১১টায় উদ্ধারযান রুস্তম ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর মূল উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে লঞ্চটিকে টেনে তোলা সম্ভব হয়। এর পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সেটিকে টেনে পাটুরিয়া ঘাটের অদূরে বড়রিয়া এলাকায় পদ্মাতীরে রাখা হয়।
ভোর সাড়ে ৪টার দিকে লঞ্চটি পানি থেকে টেনে তোলার সময় ভেতরে কয়েকজনের লাশ ঝুলতে দেখা যায়। উদ্ধারকর্মীরা সেগুলো দ্রুত উদ্ধার করেন। লঞ্চটি উদ্ধারের পর দেখা যায়, কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চটির মাঝামাঝি অংশ দুমড়ে-মুচড়ে গছে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা পরিদর্শক জিহাদ মিয়া সমকালকে বলেন, লঞ্চটি টেনে তোলার পর দোতলার কেবিনে একসঙ্গে ২৫টি লাশ পাওয়া যায়।
মানিকগঞ্জ জেলার সার্কেল এএসপি হারুনার রশিদ জানান, লঞ্চ ও কার্গোর চালকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। তিনজনকেই ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চচালক আফজাল হোসেনসহ তার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একই ধারায় সোমবার বিকেলে মামলা করা হয়েছে। তবে তাদের এখনও আটক করা যায়নি।
এখনও নিখোঁজ যারা :স্বজনদের দাবি অনুযায়ী এখনও ছয়জন নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের মধ্যে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ঢাকা হেড অফিসের কর্মকর্তা মোস্তফা মাহাফুজ দানা (৪৫), কুষ্টিয়ার লিপি বেগম (২২), মানিকগঞ্জের শিবালয়ের আবুল হাশেম (৫৫), ঝিনাইদহের মারুফা খাতুন (৫), ফরিদপুরের জুয়েল রানা (২৭) ও দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের বাবুর্চি সোহরাব হোসেন (৪৫)।
নিহতদের পরিচয় :লঞ্চডুবির ঘটনায় লাশ উদ্ধারের পর পরিচয় শনাক্ত হওয়া ৬৯ জনের মধ্যে রাজবাড়ী জেলার ২০ জন, কুষ্টিয়ার ১৯, ফরিদপুরের ১১, মানিকগঞ্জের ৮, নড়াইলের ৫, গোপালগঞ্জের ৩, ঢাকা জেলার দু'জন এবং কুমিল্লা জেলার একজন রয়েছেন। পরিচয় শনাক্ত না হওয়া এক নারীর মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে।
তাদের মধ্যে রাজবাড়ী জেলার নবিজান (৬৫), হালিমা বেগম (৪৫), অসিমা রানী (৪০), নাসিমা আক্তার (৩৬), রহমান (৫৪), ইনামুল (১৪), নুশরাত (১৮ মাস), মনজিলা বেগম (৪৫), রত্না আক্তার, উৎসব (৭), সাফেরা (৫০), ফাতেমা (২), রেখা রানী হালদার (৪৭), হালিমা বেগম (৪৫), মঞ্জিলা বেগম (৪৪), হলিমা বেগম (৪৪), রুমা (২৫), উৎসব (৭), সাফেরা বেগম (৫০), রেখা মালাকার (৪৭) ও জয়নাল শেখ (৫০) রয়েছেন। কুষ্টিয়ার ১৯ জনের মধ্যে রয়েছেন_ মধুসূদন সাহা (৩০), নাছির হোসেন (৪০), মেহেদি হাসান বাপ্পী (৩০), মোস্তফা খাতুন (৩৩), বীথি খাতুন (১৫), আসাদুল (২০), ইনামুন হক (১৮), ইমামুল (১৮), মদিনা (৭০), রাইসান হক (২), ডলি খাতুন (৩৪), গোলাম মোস্তফা (৫৫), নবনীতা পাল (২৮), নায়না (৬), ফাতেমা (২), শরিফুল ইসলাম (২৪), শরিফ (২৪), বানেজ আলী (৫৫) ও সাগু (২৫)। ফরিদপুরের ১১ জন হলেন_ পাপন (৫), রতন সরকার (৩৪), স্বপন সরকার (৫০), চম্পা রানী (৫৮), অর্চনা মালো, নারগিস আক্তার, শারমিন (২৫), মারজানা (৬), দেবনাথ মালো (৫৫), অনিমা মালো (৪৫) ও মমতা বেগম (৪৭)। মানিকগঞ্জের আটজন হলেন_ লতা (২২), আবুল কাশেম (৪৫), অঞ্জলি সূত্রধর (৬০), ইমরান (৮), ইমন (৪), সেলিম (২২), হোসাইন মোল্লা (১৮ মাস) ও রতন সরকার (১৮)। নড়াইলের পাঁচজনের মধ্যে রয়েছেন_ আমেনা বেগম (৩৫), হাফসা (৮), হোসাইন কবির (২৮), কেয়ামনি আদুরি (৭) ও রিয়া (৩)। গোপালগঞ্জের তিনজন হলেন_ নোয়াব শেখ (১৩ মাস), শাহানাজ (৪৫) ও রিনা বেগম (২৭)। এ ছাড়া ঢাকা জেলার দু'জন হলেন নবাবগঞ্জ উপজেলার সুফিয়া (২৮) ও দেড় বছরের শিশু ফারজানা স্মৃতি এবং কুমিল্লার আবুল হাসেম।

No comments

Powered by Blogger.