আমার মায়ের লাশ কই? by রিপন আনসারী

‘সবাই লাশ পাইলো, আমার মায়ের লাশটা কই? আমার মাইরে না নিয়া আমি এই খান থেইক্যা বাড়ি যামু না। আল্লাহ আমারে কেন বাঁচাইয়া রাখলো। মায়ের সাথে আমি কেন নিখুঁজ হইলাম না।’ এভাবেই পদ্মার পাড়ে কাঁদছে নিখোঁজ শাহেদা খাতুনের ছেলে মোস্তফা। নড়াইল জেলার লোহাগাড়া থানার লঙ্কারচর গ্রামের শাহেদা ও তার ছেলে মোস্তফা ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে লঞ্চ ডুবির কবলে পড়েন। ভাগ্যক্রমে মোস্তফা বেঁচে গেলেও মা শাহেদা এখনও নিখোঁজ। পদ্মাপাড়ে আহাজারি করছে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি গ্রামের রিপন শেখ। একমাত্র বুকের ধন দুই বছরের মারিয়া পদ্মার পানিতে কোথায় ভেসে গেছে কেউ জানে না। হয় জীবিত আর না হয় মৃত তারপরও মেয়ে চাই। দুইদিন ধরে সন্তানের কোমল মুখটি দেখার জন্য পাগলপ্রায় হতভাগা এই পিতা। চিৎকার করে কাঁদছে আর দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছে সে। শিশু মারিয়া খালার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল ঢাকায়। সেখান থেকে ফেরার পথে দুই জনই লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হয়। সকালে খালা রোজিনার মৃতদেহ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ রয়েছে মারিয়া। নড়াইলের বিউটি আক্তার অবশেষে তার ৭ বছরের কন্যা কেয়ার লাশ পেলেও তার মা আনোয়ারা বেগমের লাশ না পেয়ে হাউ মাউ করে কাঁদছে পাটুরিয়া ঘাটে। লাশ রাখার ঘরে মাটিতে লুটিয়ে এক পলকে সন্তানের মৃতদেহ দেখছে। কখনো চিৎকার করে কাঁদছে আবার কখনও নীরব। কিন্তু জন্মদাত্রী মা কোথায় ভেসে গেছে তা কারো জানা নেই। রোববার নবীনগর থেকে আনোয়ারা বেগম তার নাতনি কেয়াকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হন। নাতিনের মৃতদেহ ১৭ ঘণ্টা পর গতকাল ভোরে উদ্ধার করা হলেও অপরজন নিখোঁজ।
নিখোঁজ রয়েছে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার মানু মিয়া। ফরিদপুরে ভাতিজার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হন। বেসরকারি এনজিও ব্র্যাকের অডিট অফিসার মেহফুজ আহমেদও নিখোঁজ। রোববার এমভি মোস্তফা লঞ্চযোগে মেহফুজ, মো. রফিক মিয়া ও আবুল কালামসহ তিনজন অডিট অফিসার যাচ্ছিলেন কুষ্টিয়া জেলার একটি অফিসে অডিটের কাজে। লঞ্চ দুর্ঘটনায় রফিক ও কালাম অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে উঠলেও হারিয়ে যান মেহফুজ। গতকাল সকালে লঞ্চটি উদ্ধার হলেও মেহফুজ উদ্ধার হয়নি। তার মরদেহ খুঁজতে গতকাল প্রায় সারা দিন ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ ও স্বজনরা পদ্মার ভাটি অঞ্চলে ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও তার কোন সন্ধান পায়নি।
 এক কন্যাকে এয়ারপোর্টে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আরেক কন্যাকে সঙ্গী করে এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন হতভাগা বাবা জয়নাল শেখ (৬৫)। রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় পাটুরিয়া ঘাটের পুলিশ ফাঁড়ির সামনে রাস্তার ওপর রাখা হয়েছিল লঞ্চডুবিতে নিহত পিতা ও কন্যা নারগিসের মরদেহ। পরে রাত দেড়টার দিকে শনাক্ত করে লাশ নিয়ে যায় পরিবারের লোকজন। দুর্ঘটনায় বেঁচে যায় জয়নালের ছেলে রফিক ও আরেক মেয়ে বুলবুলি। বেঁচে যাওয়া ভাইবোনের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠে মাঝ রাতের পাটুরিয়া ঘাটের বাতাস।
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া রফিক জানান, রোববার বোন রহিমাকে শাহজালাল বিমান বন্দরে বিদায় জানিয়ে লঞ্চযোগে বাবা, আমি ও দুই বোনসহ আমরা চার জন গ্রামের বাড়ি শিবরামপুরে ফিরছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একটি কার্গো জাহাজ তাদের বহনকারী লঞ্চটিকে সজোরে আঘাত করলে লঞ্চটি মাঝ নদীতে ডুবে যায়। ভাগ্যক্রমে আমি ও আমার এক বোন প্রাণে বেঁচে গেলেও বাবা ও আরেক বোন নিখোঁজ হয়। রাতে ডুবুরিরা বাবা ও বোনের লাশ উদ্ধার করে।
কুষ্টিয়া লালন শাহ এলাকা থেকে বড় ছেলের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে বেড়ানো শেষে পুত্র ও নাতিনকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে লাশ হয়েছেন মদিনা বেগম (৭০), ছেলে শাবলু (২৫) ও নাতনি লাবণী আক্তার মুক্তা (১৩)। তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে রোবরার রাতেই। আদরের কন্যা, প্রিয় মা ও ছোট ভাইকে হারিয়ে নির্বাক লাবু মিয়া। তার কান্না আর আহাজারি শত মানুষের চোখের পানি ঝরিয়েছে।
গত দুই দিন ধরে স্বজনদের এরকম আহাজারি ও আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছিল পদ্মার পাড়। তবে এখনও অনেক নিখোঁজ যাত্রীর স্বজনদের ভিড় গতকাল বিকাল পর্যন্ত পাটুরিয়া ঘাটে দেখা গেছে। ৭০টি মৃতদেহ উদ্ধার হলেও আরো কিছু লাশ নদীর ভাটিতে ভেসে গেছে বলে মনে করছেন নিখোঁজদের স্বজনরা।
৭০ লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ অনেক
ওদিকে দুর্ঘটনার দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টা পর অবশেষে পাটুরিয়ার পদ্মায় নিমজ্জিত এমভি মোস্তফা নামক লঞ্চটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম। সেই সঙ্গে গতকাল ভোর সাড়ে ৪টার দিকে লঞ্চের ভেতর থেকে আরো ২৯টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে ১৭ ঘণ্টায় ৭০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে নারী ২৮, পুরুষ ২৭ ও শিশু রয়েছে ১৫। আর ৬৯ জনের মরদেহ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একটি মৃতদেহের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। এছাড়া, গতকাল সকাল ১১টার দিকে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উদ্ধার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক ভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছেন।
পাটুরিয়া ঘাটে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমে সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস জানান, রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে সারবাহী কার্গোর ধাক্কায় এমভি মোস্তফা নামের লঞ্চডুবির ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ৭০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ৬ জন।     
দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চের ফিটনেস ছিল ২ দিন: সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শফিউর রহমান জানান, দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটির ফিটনেসের মেয়াদ ছিল আর মাত্র ২ দিন। ২৪শে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হতো সনদের মেয়াদকাল। তিনি জানান, এই লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল ১৪০ জনের। 
কে এই লঞ্চের মালিক: দুর্ঘটনাকবলিত এমভি মোস্তফা লঞ্চটির মালিক হচ্ছেন শিবালয় উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম খান। তিনি আরিচা লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। প্রভাবশালী এই নেতা দুর্ঘটনার পর এলাকা ছাড়া। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সেল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
পালিয়েছে লঞ্চের মাস্টার: এমভি মোস্তফা লঞ্চের মাস্টার আফজাল হোসেন ঘটনার পর থেকে পলাতক। পুলিশও তাকে খুঁজছে বলে জানিয়েছে শিবালয় থানার ওসি।
কার্গো জাহাজের তিনজন আটক: এ ঘটনায় নার্গিস-১ কার্গোর তিনজনকে পুলিশ আটক করেছে। এরা হলো- কার্গোর তিন লস্কর শাহীনুর রহমান (২১), শহীদুল ইসলাম (২৪) ও জহিরুল ইসলাম (২১)।
পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন: অপরদিকে, লঞ্চডুবে যাওয়ার ঘটনা তদন্তের জন্য এ পর্যন্ত তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নৌ-মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটিতে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান ড. শামসুজ্জোহা খন্দকারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন মো. শাহজাহানকে প্রধান করে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর-উর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় শোকের মাতম
দেলোয়ার মানিক, কুষ্টিয়া থেকে জানান, পাটুরিয়ার কাছে পদ্মায় লঞ্চডুবির ঘটনায় যে মরদেহ উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে কুষ্টিয়ারই ২০ জন। নিহতদের তালিকায় তিন পরিবারের ৯ জনসহ এক ডাক্তার ও প্রকৌশলীও রয়েছেন। তাদের বাড়ি কুমারখালী, খোকসা, মিরপুর ও সদর উপজেলায়। নিহতদের পরিবারগুলোতে চলছে শোকের মাতম। আর কুষ্টিয়া জুড়ে নেমেছে শোকের ছায়া। কুষ্টিয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, জেলার খোকসা উপজেলার ৪ জন, কুমারখালী উপজেলার ১১ জন, সদর উপজেলার ৪ জন এবং মিরপুর উপজেলার ১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে।
কুমারখালী উপজেলার নিহতরা হলেন- সাবু (৩০), মর্জিনা খাতুন (৫৬), লাবণী (১৪), রেবেকা খাতুন (২৯), রাইসান (৩), বীথি খাতুন (১৪), মোস্তফা বিশ্বাস (৬০), হাফেজ ইউনুস আলী (৩০), ফাতেমা (২), মধুসূদন সাহা (৬৫) ও তারা ওরফে ডলি (৩০)।
একই উপজেলার সাঁওতা গ্রামের ফারুক জানান, তার স্ত্রী রেবেকা খাতুন (২৯) তার তিন বছরের ছেলে রাইসান ও মেয়ে বীথি খাতুন (১৪)কে নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকায় এক কবিরাজের বাড়িতে মানত শোধ করতে। মানত শোধ করে বাড়ি ফেরা হয়নি তাদের। একই পরিবারের তিন জনের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ পরিবারের স্বজনরা। এছাড়া একই এলাকার মোস্তফা বিশ্বাস (৬০) মৃত্যুবরণ করেছেন। ব্যবসায়িক কাজ শেষে বাড়ি ফেরার কথা ছিল কুমারখালী শহরের কুণ্ডুপাড়া এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী মধুসূদন সাহার (৬৫)। কিন্তু লঞ্চডুবিতে বাড়ি ফিরেছে লাশ হয়ে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নির্বাক পরিবারের সদস্যরা।
খোকসা উপজেলার নিহতরা হলেন- লতা (২২), পুলক (২), এনামুল (১৪) ও গোলাম মোস্তফা (৫৭)। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, খোকসা উপজেলার জয়ন্তিহাজরা ইউনিয়নের মহিষবাথান গ্রামের একই পরিবারের ৩ জন, ইসমাইল হোসেনের মেয়ে লতা (২২), আড়াই বছরের ছেলে পুলক হোসাইন এবং ছোটভাই এনামুল (১৪) মৃত্যুবরণ করেছে। একই উপজেলার সাতপাখিয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা (৫৭) মৃত্যুবরণ করেছেন। মিরপুর উপজেলার আমলা সদরপুর স্কুল পাড়ার স্কুলপাড়া এলাকার আনসার আলীর ছেলে আসাদুল হক (২৭) মৃত্যুবরণ করেছেন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার নিহতরা হলেন- নাসির (২৯), নাইমা (৬), প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বাপ্পী (৩২) ও ডা. নবনীতা কুমার পাল (৩০)। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়া (ভাটাপাড়া) এলাকার নাসির (২৯) তার দুই মেয়েকে বাড়িতে রাখার জন্য ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন। লঞ্চডুবিতে মৃত্যুর পর নাসির ও মেয়ে নাইমার (৬) লাশ উদ্ধার হয়েছে। একই সঙ্গে থাকা ছোট মেয়ে নোহা (৪)কে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
এদিকে কুষ্টিয়া শহরের নতুন কমলাপুর এলাকার সান্টু মিয়ার ছেলে প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বাপ্পী (৩২) ও ডা. অসীম কুমার পালের কন্যা নবনীতা কুমার পাল (৩০) নিহতের তালিকায় রয়েছেন।
কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সালেহা আক্তার জানান, নিহতদের লাশ প্রশাসন তদারকির মাধ্যমে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। সকলের লাশ সুষ্ঠুভাবে দাফন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.