বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এ হাল কেন? by বিমল সরকার

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনে তালা, পাঠদান মাঠে
১৯৭২ সালের ঘটনা। ড. সত্যেন সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। অনিয়ম ও অসঙ্গতির কারণে বিএ, বিএসসি ও বিকম পরীক্ষার্থীদের কিছু উত্তরপত্র বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবিতে পরীক্ষার্থীরা দফায় দফায় বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে থাকে। ১৩ এপ্রিল টানা ছয় ঘণ্টা অবরোধ-দশা থেকে মুক্ত হয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত ও অনেকটা হতাশ হয়ে ভিসি পুরো বিষয়টি জানিয়ে রাজ্য গভর্নরের কাছে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, বেপরোয়া শিক্ষার্থীদের এভাবে বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি চালাতে দিলে এবং এসব তৎপরতা বন্ধ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না। ড. সেন রাজ্য সরকারের কাছে এ ব্যাখ্যাও চান যে, জোরপূর্বক ভিসি ও অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা এবং কর্মচারীদের অফিসে যাতায়াতে বাধা সৃষ্টিকারী ছাত্রদের কার্যকলাপ আর কতদিন মার্জনা করা যাবে। পরদিন ছাত্র বিক্ষোভ ও ঘেরাও : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আশংকা ঠিক এ ধরনের শিরোনামে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। ঘটনাটি তেমন গুরুতর কিছু না হলেও একজন ভিসি যখন দায়িত্বে থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়ার আশংকা ব্যক্ত করেন তখন বিষয়টি আর সামান্য থাকে না। সত্যেন সেনের বেলায় একসময় ঘেরাওয়ি ভিসি এবং মোস্ট ঘেরাউড ভিসির এবংবিধ নানা বিশেষণ ব্যবহার করা হতো। তার কর্মদক্ষতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। বলাবাহুল্য, চিঠি লেখার দুদিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
আমরা বলতে গেলে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংশয়-সন্দেহ আর অনাস্থা-অবিশ্বাসের ওপর ভর করে পথ হেঁটে চলেছি। আস্থা বা বিশ্বাস রাখার মতো জায়গা দিন দিন কেবল সংকুচিতই হচ্ছে। আর তাই জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা করার ক্ষেত্রগুলোকেও অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করে দেখতে পারি না। কখন যে কাকে ন্যায় আর যৌক্তিক বলি আবার পরক্ষণেই অন্যায় আর অযৌক্তিক ভাবি, তা বোধকরি নিজেরাও বলতে পারি না। বোধকরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একেবারে সূচনালগ্ন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মসজিদ-মন্দিরের সঙ্গে তুলনা করে আসা হচ্ছে। কিন্তু হলে কী হবে- ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এক একটি বড় ও পবিত্র প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসের পর মাস ধরে অচল হয়ে পড়ে থাকলেও আমরা থাকি একেবারে নীরব-নির্বিকার।
দেশে উচ্চশিক্ষা দানের অন্যতম পাদপীঠ হিসেবে পরিচিত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। একের পর এক নানা কর্মসূচি ও আন্দোলনে একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম। তিন দিন নয়, তিন সপ্তাহও নয়, গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে প্রশাসনিক কার্যক্রমও। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তিচ্ছু ৯০ হাজারের বেশি আবেদনকারী ভর্তির ব্যাপারে রয়েছে অন্ধকারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি, অস্থিরতা, সমস্যা বা সংকট আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। এমনকি কখনও কখনও বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আন্দোলন-অস্থিরতায় উত্তাল হয়ে উঠতে দেখা যায়। তবে যেসব ইস্যুতে এবং যেভাবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দীর্ঘদিন ধরে অচল করে রাখা হয়েছে এর নজির বিরল। যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা সবার জন্যই ভাবনা বা গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক সময় বিশেষ কোনো ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে ক্যাম্পাস গরম করে তুলতে দেখা যায়। দাবি অযৌক্তিক হলে সে আন্দোলন অবদমিতও হয়ে পড়ে। কিন্তু বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সেরকম কিছু মনে হয় না। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচিতে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এককথায় বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিপুলসংখ্যক ব্যক্তির অংশগ্রহণে সৃষ্টি হয়েছে চরম অচলাবস্থার। গত বছরের নভেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রশাসনিক ও একাডেমিক পদ থেকে শিক্ষকরা পদত্যাগ করেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে পরবর্তীকালে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হলেও আন্দোলনকারীরা নতুন এসব নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে (চলতি দায়িত্ব) লাঞ্ছিত করা হয়। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, থানা পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা আরও কত কী। ভিসিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই। ক্লাস হচ্ছে না, হচ্ছে না পরীক্ষা। ভিসি এবং আন্দোলনকারীদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। এরই মাঝে শুরু হয়েছে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। এছাড়া একদল ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ ও ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করলে তাদের ওপর গভীর রাতে হয়েছে অতর্কিত হামলা এবং এতে দুজন সম্মানিত শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র আহত হয়েছেন।
বিগত শতকের আশির দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আকস্মিক সরকারি নির্দেশে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঘন ঘন বন্ধ করে দেয়া হতো। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসের পর মাস ধরে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই ছিলেন বলতে গেলে নির্বিকার কিংবা বলা যায় নিরুপায়। এক মাস, দুই মাস, এমনকি আশির দশকে একেবারে টানা ৪ থেকে ৫ মাস সরকারি নির্দেশে দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে বন্ধ করে রাখা হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। প্রশ্ন হল, সামরিক শাসনামল বলে না হয় সেসব মেনে নেয়া গেল, কিন্তু এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে অচল হয়ে থাকবে কেন? বিশেষ করে মাসের পর মাস? শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার পক্ষ থেকে কিছু দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। ন্যায্য-অন্যায্য ও দাবি-দাওয়া পূরণের সম্ভাব্যতা-যৌক্তিকতা যাচাই-বাছাই করে দেখবে প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গোটা শিক্ষা কার্যক্রমকে স্থবির বা জিম্মি করে দাবি পূরণের এ কোন ধরনের আন্দোলন? অন্যদিকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ও ভাগ্য যেখানে নির্ভর করছে এমন একটি বিষয় নিয়ে কর্তৃপক্ষের এরূপ নির্লিপ্ততা বা উদাসীনতারই বা হেতু কী?
বিগত মহাজোট সরকারের আমলে, এমনকি বর্তমান সরকারের আমলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি ও সাফল্য দৃশ্যমান। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সর্বাÍক অভিযান কিংবা ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন কার্যক্রম দেশবাসীর মনে ব্যাপক আশা-আকাক্সক্ষা ও জাগরণের সৃষ্টি করেছে। তা সত্ত্বেও বেশকিছু দিন ধরে বিভিন্ন মহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মোটা দাগে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষায় একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস, পাসের হার, দেশে শিক্ষার মান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ দেয়া না দেয়া, উচ্চশিক্ষায় আসন সংকট, সেশনজট প্রভৃতি আলোচনা-সমালোচনার মূল বিষয়।
গত তিন মাস ধরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা নিয়ে পত্রপত্রিকায় একের পর এক অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে বেশ খোলামেলাভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নানা অনিয়ম, অব্যবস্থা এবং সংঘটিত দুর্নীতির কারণেই আজকের এ অনভিপ্রেত পরিস্থিতি। এছাড়া শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভক্তির বিষয়টি তো রয়েছেই। ৭ ফেব্র“য়ারি যুগান্তরে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ... মূলত দুর্নীতির অভিযোগে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাবেক ভিসির সুবিধাভোগী শিক্ষক, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী, সাবেক ভিসির নিয়োগপ্রাপ্ত ভাই, ভায়রা, ভাতিজি, ভাগ্নি, শ্যালিকা, নাতি-নাতনি, মেয়ে, জামাতাসহ ৪০ নিকটাত্মীয় ও স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি এ আন্দোলনের নেপথ্যে রসদ জোগাচ্ছেন. . .। আমার জানামতে নতুন শিক্ষাবর্ষে অনার্স ভর্তির ব্যাপারে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এত পিছিয়ে নেই। এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনার্স প্রথমবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে ক্লাস শুরু করতে যাচ্ছে ২২ ফেব্র“য়ারি। দেশে রাজনৈতিক ডামাডোল, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং আতংক থাকলেও যেভাবেই হোক শিক্ষার চাকাটি কিন্তু একেবারে অচল হয়ে পড়ে থাকেনি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির দিকে নজর দেয়ার কি কেউ নেই?
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
bimalsarker59@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.