গণতন্ত্রের জন্য একবার কাঁদুন by সৈয়দা পাপিয়া

বার্ন ইউনিটের দগ্ধ মানুষ পুলিশ-র‌্যাবের গুলি খেয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি, যত্রতত্র পড়ে থাকা লাশ- এগুলো যেন প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যতবার প্রধানমন্ত্রী বার্ন ইউনিটে যাচ্ছেন ততবারই কাঁদছেন, বিদেশীদের বার্ন ইউনিটের ভিডিওচিত্র দেখানো হচ্ছে আর তিনি কেঁদেই চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে আক্রমণাত্মক ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন, কিন্তু বার্ন ইউনিটের কথা বলতে গিয়ে চশমা খুলে চোখ মুছছেন।
প্রধানমন্ত্রী এত কাঁদছেন, কিন্তু কান্না শেষ করার জন্য সমাধানের চেষ্টা করাই জরুরি। এই কান্নার সমাপ্তি টানার জন্য কেউ ব্যবস্থা নিলেই তার দল গালিগালাজ করছে। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, প্রধানমন্ত্রী বার্ন ইউনিটে দগ্ধ মানুষকে দেখতে গেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোমবাতির আগুনে পোড়া শিশুটিকে পেট্রলবোমায় দগ্ধ বলে হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ দেখিয়েছে এবং কাঁদিয়েছে। এভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার সাথে প্রতারণা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বার্ন ইউনিটে গিয়ে কান্না বেশ প্রচারিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, কান্নার কারণে আওয়ামী লীগ দেশে ও বিদেশে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
এ দিকে বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ কোথাও পেট্রলবোমা মারার সময় ধরা পড়েছেÑ কখনো মেরে পালানোর সময় ধরা পড়েছে। থানায় আওয়ামী লীগের তদবিরে শুধু পুলিশ ছেড়ে দিতেই বাধ্য হয়নি, মামলা পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। প্রথমত, পুলিশের পাহারায় পেট্রলবোমা মেরে ঢাকাসহ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বিভিন্ন জায়গায় মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। এতে সরকার সব দায় ২০ দলের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এক দিকে যেমন মিডিয়াকে বার্ন ইউনিট নিয়ে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে, অন্য দিকে টকশো থেকে শুরু করে সব আলোচনার বিষয়বস্তু ‘দগ্ধ মানুষ ও সহিংসতা’।
দ্বিতীয়ত, পেট্রলবোমার নাম দিয়ে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে শত শত ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন এবং অনেককে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে। এভাবে কৌশলে ২০ দলীয় জোটের সাহসী কর্মীদের সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে।
তৃতীয়ত, বার্ন ইউনিট নিয়ে যত প্রচার ও আবেদন সৃষ্টি করা যাবে, তত এ ঘটনার সাথে ‘সরকার জড়িত নয়’ মর্মে ধারণা দেয়ার একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি, অবরোধ-হরতালের ঘোষণা যেহেতু ২০ দলীয় জোট দিচ্ছে, সেহেতু অনায়াসে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যাবে বোমাবাজির যত দায়। শুধু তাই নয়, বার্ন ইউনিটের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, মৃত্যুযন্ত্রণা, কষ্টকর অধ্যায়, আত্মীয়স্বজনের আহাজারি ইত্যাদি ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে সারা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এমন কোনো ছবি, সংবাদ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সরকারের সরাসরি নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রচার সেল এসব ভিডিওচিত্র ধারণ করে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাংবাদিক ও বিদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দকে আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলো দেখিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপিকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দানবের দল, সন্ত্রাসী সংগঠন, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদের সাথে তুলনা করে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার এক সুনিপুণ প্রচেষ্টা সরকার অব্যাহত রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী আপনি যত কাঁদবেন ততই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কারণ, আপনার কান্না দেখে কাঁদছে পেট্রলবোমা ছোড়া ছাত্রলীগকর্মী, আপনার সাথে কাঁদছেন সেসব পুলিশ কর্মকর্তা যারা প্রতিনিয়ত বলেছেন- ‘দেখামাত্র গুলি’, ‘অস্ত্র দিয়েছে হা-ডু-ডু খেলার জন্য নয়।’ কেউ কেউ বলেছেন, সহিংসতায় জড়িতদের বংশধর পর্যন্ত ধ্বংস করে দেয়া হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনেককে বিনাবিচারে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, আপনার কান্না দেখে সেই কর্মকর্তারাও কাঁদছেন। আরো কাঁদছেন আপনার সেই নেতারা, যারা ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে লুঙ্গি পরে ঢাকাবাসীকে ‘হ্যাডম’ দেখাতে চেয়েছিলেন, শ্রমিকদের ঘেরাও কর্মসূচির নাম করে এক মহিলা সংসদ সদস্য বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান অফিস বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তারাও কাঁদছেন। এ কান্না নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তবে বলে নেয়া ভালো, যেকোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুই হৃদয়বিদারক। বার্ন ইউনিটের মর্মান্তিক যাতনা, অবর্ণনীয় কষ্ট ও মৃত্যু নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তাই অবিলম্বে সত্যিকারের অপরাধীদের ধরে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করাই সময়ের দাবি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, লাশ নিয়ে কান্না শুধু বার্ন ইউনিট-কেন্দ্রিক কেন হবে? প্রতিটি হাসপাতালের মর্গের খবর নিন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে বেওয়ারিশ লাশের দাফনের সংখ্যা জানুন। ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নয়ন বাছার চিৎকার দিয়ে বলছে, পুলিশ গুলি করার আগে বারবার বলেছি- ‘আমি শিবির নই, আমি হিন্দু নয়ন বাছার, পেট্রলবোমা মারতে আসিনি; আমি পথচারী।’ তার পরও পুলিশ তাকে গুলি করেছে। ছেলের ওষুধ কেনার পয়সা কোথায় পাব? এই বলে চিৎকার করছেন নয়নের ভাগ্যহত মা শিখা রানী। ক্রসফায়ারে নিহত জনির সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর আর্তনাদ, যত্রতত্র পড়ে থাকা লাশের গুলিতে ঝাঁঝরা শরীর, যৌথবাহিনী বহু মানুষকে বাড়িছাড়া করছে, বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে, গাছের নিচে আশ্রয় নেয়ার অবস্থা সৃষ্টি করেছে। অনেক মায়ের কোল খালি করে যৌথবাহিনী সন্তানকে তুলে নিয়ে গেছে, এখনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারকে পুলিশ শাসিয়ে দিয়েছেÑ অপহরণের কথা বললে পরিবারসহ ক্রসফায়ার। স্বামী না পেলে স্ত্রীকে ধরে আনছে। বাবাকে না পেয়ে সন্তানকে তুলে আনছে। সর্বশেষ সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় ৩২ জনের অকালমৃত্যু। ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী সবাই গাড়ি ভাঙচুর, পেট্রলবোমা, ককটেল মারার আসামি- এ কোন দেশ, কোন ধরনের শাসন এটি? প্রতিহিংসার দাবানলে মরছে মানুষ, জ্বলছে দেশ।
এ কোন বাংলাদেশ উপহার পাচ্ছে জনগণ? ১৬ কোটি মানুষ দেখছে দগ্ধ মানুষ, গুলিবিদ্ধ লাশ, হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ যুবকের আর্তচিৎকার, স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি, ওসমানী হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়া ৩২ জন রোগীর স্বজনদের আর্তনাদ, মামলায় জর্জরিত লাখো মানুষ, দগ্ধ রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত গণতন্ত্র।
আপনি কাঁদুন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার্ন ইউনিটে গিয়ে কাঁদুন, রাস্তা ঘাটে গুলিবিদ্ধ গলিত লাশ নিয়ে কাঁদুন, গুলিবিদ্ধ শত যুবকের বাঁচার আকুতি দেখে কাঁদুন, যৌথবাহিনীর অত্যাচারে সহায়সম্বলহীন আশ্রয়হারা মানুষের আহাজারি দেখে কাঁদুন। নবজাতক জন্ম নিলো, চোখ মেলে দেখল বাবার লাশ। সেই অসহায় মায়ের আর্তনাদ দেখে অন্তত একবার কাঁদুন। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর হাহাকার আর নিঃসঙ্গতা দেখে কাঁদুন। সন্তান চিরতরে হারিয়ে জ্ঞান হারানো মায়ের অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে কাঁদুন, নাতির ক্রসফায়ারে মৃত্যুর খবর শুনে সহ্য করতে না পেরে নানার আকস্মিক মৃত্যুর যাতনা উপলব্ধি করে কাঁদুন।
সর্বোপরি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা, কিছু সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করার কারণে কাঁদছেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীরা। মিডিয়ার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে মিডিয়াকর্মীদের বোবাকান্না, টকশোতে গিয়ে মনের কথা বলতে না পারার অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা। টকশোতে অনেকের উপস্থিতির ওপর বিধিনিষেধ থাকায় তাদের দেখতে না পেয়ে বিষণœ দেশের মানুষ।
মন্ত্রীদের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে চরম অবাঞ্ছিত বক্তব্য শুনে গুমরে কাঁদছে গণতন্ত্র। দেশ-জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে আসা বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে চরম অসম্মানজনক বক্তব্য শুনে কাঁদছে সচেতন মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও চেতনা।
গণতন্ত্রের কী হাল হয়েছে, সেটা দেখে কাঁদুন- দেখবেন মনটাও হালকা হবে, সমাধানের পথও খুঁজে পাবেন। জনগণের আকুতি- দেশবাসীর কান্না বন্ধ করুন, বেহাল দশা থেকে গণতন্ত্র যেন মুক্তি পায়। বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের আজন্ম আকাক্সা পূরণে অবদান রাখুন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

No comments

Powered by Blogger.