সর্বনাশা কর্মসূচির শেষ কোথায়

অদ্ভুত এক আঁধার গ্রাস করেছে পুরো দেশকে। যে আঁধারে মরণ আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে পেট্রোল বোমা, ককটেল, পুড়ছে মানুষ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের লাগাতার অবরোধের ৫০ দিন পূর্ণ হলো আজ। এ সময়ে টাকার অঙ্কে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৯১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তার চেয়েও বড় যে ক্ষতি হয়েছে তা পরিমাপের কোনো একক নেই। প্রাণহানি হয়েছে ১০৬ জনের। আহত হয়েছেন হাজারো মানুষ।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন করে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। তখনও সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শিথিল হতো কর্মসূচি। এবার ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও শিথিল হয়নি অবরোধ। অবরোধের পাশাপাশি আবার হরতালও দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই প্রাণহানি ঘটছে।
এখন পর্যন্ত যে ১০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে জীবন হারিয়েছেন ৫৫ জন। আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে যানবাহনে দুর্বৃত্তের হামলায়। পিকেটারের ছোড়া ঢিলে নিহত হয়েছেন দুই জন। এই ৬০ জনই সাধারণ মানুষ। যাদের রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। ৩১ জনই সাধারণ খেটে যাওয়া মানুষ। পরিবহন চালক-শ্রমিক। নারী নিহত হয়েছেন ৯ জন।
সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১৩ জন। তাদের সবাই রাজনৈতিক কর্মী। ১১ জন বিএনপি-জামায়াতের কর্মী। আওয়ামী লীগের কর্মী দুইজন। 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন ২৮ জন। পুলিশের দাবি তারা নাশকতাকারী। তবে তাদের পরিবারের দাবি, তাদের ধরে নিয়ে পুলিশ হত্যা করেছে। 'বোমা মারার' সময় তিনজন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। বোমা বানাতে গিয়ে যুবদল ও ছাত্রদলের দুই নেতা নিহত হন। 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহতদের ৯ জন বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। ৮ জন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। এছাড়াও অবরোধ চলাকালে আরও দুইজন 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়েছে তিন রাজনৈতিক কর্মীর। রংপুর মিঠাপুকুর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান বাসেত মারজানসহ পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের পরিবারের দাবি, পুলিশ পরিচয়ে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারির পর থেকে এখন পর্যন্ত সারাদেশে আটক ও গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার জনকে। এ সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বোমা হামলায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন প্রায় তিনশ' জন। ভাংচুরের শিকার হয়েছে পুলিশের শতাধিক যানবাহন।
অবরোধে যানবাহন পুড়েছে ৬১২টি। ভাংচুর করা হয়েছে আরও অন্তত ৯০০টি। এতে ক্ষয়ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। ট্রেনে হামলা হয়েছে ১১ বার। তবে এতে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেনি। রেল মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি যৎসামান্য হয়েছে।
ক্ষতির বোঝায় জর্জরিত অর্থনীতি :ঢাকা চেম্বারের হিসাবে একদিনের হরতাল কিংবা অবরোধে ২ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। প্রতিদিন শিল্প উৎপাদন সক্ষমতায় ২৫ শতাংশ ক্ষতি ধরলে এর পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। ঢাকা চেম্বার, এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির ১৬ খাতে গত ৫০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তবে এর বাইরের সব খাতের হিসাব করলে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা চেম্বার ও এফবিসিসিআইয়ের প্রতিদিনের ক্ষতি অনুযায়ী হিসাব করলে অবরোধ-হরতালে গত ৫০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় রফতানি পোশাকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, পরিবহন ও যোগাযোগে ১৫ হাজার কোটি টাকা, কৃষিতে ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ও আবাসনে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এ সময় পর্যটন খাতে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। পাইকারি বাজার, শপিং মল, শো রুম, ক্ষুদ্র ও ছোট দোকানে ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, স্থানীয় পোশাক খাতে ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও উৎপাদন খাতে ক্ষতি ৫ হাজার কোটি টাকা, বন্দর ও সেতুতে রাজস্ব হারানোর ফলে ক্ষতি ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা, সিরামিক শিল্পে ১ হাজার কোটি টাকা, পোলট্রি শিল্পে ক্ষতি ৯০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুত ও রফতানি শিল্পের ৯০০ কোটি টাকা করে ক্ষতি হয়েছে। দেশে বর্তমানে ৬০টি বীমা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এই বীমা খাতে ক্ষতি ৭৫০ কোটি টাকা। রাজধানীতে ছোট-বড় মিলিয়ে ভ্রাম্যমাণ এবং হকার ও অস্থায়ী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এতে হকারদের ক্ষতি ৭৫০ কোটি টাকা। বন্দরে আমদানিপণ্য খালাসে ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা ও হিমায়িত খাদ্যের ক্ষতি ৪০০ কোটি টাকা এবং আবাসন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।
আর্তনাদ, আহ্বান সবই মূল্যহীন :জীবিকার সন্ধানে পথে নেমে দগ্ধ মানুষের এত কান্না, এত আহাজারি, শান্তির জন্য নিপীড়িত মানুষের আহ্বান কানে তুলছেন না সহিংসতার রাজনীতির কুশীলবরা। বরং আরও লাশের রাজনীতির গোপন পরিকল্পনা প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে জনসমক্ষে। রাজনীতি লাশের নির্ভরতা ছেড়ে কবে জীবনের জন্য হবে, এ প্রশ্ন সচেতন বিবেকের। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, আজকের সহিংসতা সহিষ্ণুতার অভাবের ফল। দুই পক্ষই অসহিষ্ণু, নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকার কারণে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাদের চোখে পড়ছে না। এর ফলে রাজনীতিবিদদের ক্ষতি হচ্ছে না, ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ নাগরিকের। এটা খুবই দুঃখজনক। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এ সহিংসতা বন্ধ হওয়ার আশাও নেই।
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও একাধিকবার আহ্বান জানানো হয়েছে সহিংসতা বন্ধের। নিশ্চিত করার আহ্বান রয়েছে শান্তিপূর্ণ মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যও। যাদের প্রতি আহ্বান, তারা যেন অন্ধ, বধির, তাদের কানে যেন কিছুই পেঁৗছে না!
নানা শ্রেণী-পেশার মানুষও বুঝে উঠতে পারছেন না কোন পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, কবে হবে অনিশ্চয়তার সমাধান। অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের দুশ্চিন্তা তীব্র হচ্ছে। খেটে খাওয়া দিনমজুর হোসেন মিয়া কোদাল হাতে সাত সকালে কাজের আশায় বসে আছেন উত্তরা আজমপুরের ফুটপাতে। গত এক সপ্তাহে একটা কাজও পাননি। 'কিসের রাজনীতি, প্যাডে লাথি মারার রাজনীতি চাই না।' বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাবরিনা আহমেদ ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, 'রাজনীতি, গণতন্ত্র কিছুই দরকার নেই। বাসা থেকে বের হয়ে দিনের শেষে যেন সুস্থ শরীরে বাসায় ফিরতে পারি তার নিশ্চয়তা চাই।'

No comments

Powered by Blogger.