সংলাপ হবে না সমস্যাও মিটবে না

৫ই জানুয়ারির একতরফা ভোটবার্ষিকী স্মরণে পাল্টাপাল্টি সভা করার প্রস্তুতি থেকে বাংলাদেশের অবরোধ আজ ৪৯ দিনে পড়লো। কবে এর শেষ তা কারও জানা নেই। নষ্ট রাজনীতি নষ্ট উদাহরণের জন্ম দিচ্ছে। ‘ফায়ার’ ও ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। এবারে শুরুটা হয়েছিল একটা মামুলি কর্মসূচি হিসেবে। এই কর্মসূচি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে গতিপ্রকৃতির দিক থেকে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। আর বাংলাদেশ সঙ্কট ক্রমশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলছে। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায় নিয়মিতভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে চলেছেন। দু’পক্ষই দাবি করছে তারা যে যা করছে, তাতে জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। সঙ্কটের সময় বিবদমান পক্ষগুলো গণতন্ত্রের ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া এবং অসাংবিধানিক শক্তির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে থাকে। বিদেশী পত্রপত্রিকায় ইতিমধ্যে সে ধরনের জল্পনাকল্পনার খবর প্রকাশ পাচ্ছে। আবার সরকারের দিক থেকেও সে ধরনের খোয়াব না দেখতে বিরোধী দলকে সতর্কীকরণের কাজও চলছে।
তবে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী পাসের পর সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকালই অসাংবিধানিক শক্তির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। এবং সংবিধানের দণ্ডাদেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। কিছুদিন আগে বিদেশী গণমাধ্যমে সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের খবর প্রকাশের পর বার্তা সংস্থা এএফপি খবর দিয়েছিল যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ওই ধরনের জল্পনাকল্পনাকে ভিত্তিহীন বলে নাকচ করে দিয়েছে।
দুই বিবদমান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সাধারণত পরস্পর পরস্পরকে অরাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আপসকারী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের খুনি ফারুক-রশীদের এবং বিএনপি আওয়ামী লীগকে জেনারেল এরশাদ ও জেনারেল মইনের নেতৃত্বাধীন পটপরিবর্তনের বেনিফিসিয়ারি হিসেবে অভিযুক্ত ও নিন্দা করে থাকে। কিন্তু রাজনীতিতে সংবিধানবহির্ভূত হস্তক্ষেপের দায়ে এই দুই দলের আমলে কখনও কোন কর্মকর্তার বিচার করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকারের আমলে সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ে জেনারেল এরশাদের বিচারের বিষয়টি হাইকোর্টের রায়ে সমর্থিত হওয়ার পরেও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং এরশাদকে রাষ্ট্রদূত মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে।
সর্বশেষ দীর্ঘ নীরবতা বা নিষ্ক্রিয়তার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে সক্রিয় হতে শুরু করেছে। একইসঙ্গে জাতিসংঘের প্রতিনিধি তারানকোকেও সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। বিএনপি যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা চাইছে সে খবর সম্প্রতি প্রথম প্রকাশ করে টাইমস অব ইন্ডিয়া। আবার ক্ষমতাসীন দলও ড্যান মজিনাকে আক্রমণের দিনগুলোকে পেছনে ফেলতে চাইছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী মুষড়ে পড়া সম্পর্ককে দ্রুত ট্রাকে আনতে চাইছেন। বারাক ওবামার ভারত সফরের পরপরই মাহমুদ আলী মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী  জন  কেরির সঙ্গে বৈঠক করলেন। তবে  লক্ষণীয় হচ্ছে দুই বিবদমান পক্ষ বিদেশীদের ভুল উদ্ধৃতি দেয়ারও একটি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। উভয়পক্ষই দেশবাসীকে ধারণা দিচ্ছে যে, নানাবিধ বিদেশী মহল কেবল তাদের সঙ্গেই আছে। মিডিয়াও যে যার লাইনমতে খবর ছাপছে। 
এই প্রেক্ষাপটে একদিকে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারাসহ নাশকতা চলছে অন্যদিকে বিরোধী দলের সদস্য গ্রেপ্তার, রিমান্ড আর তাদের দাবি নাকচ করা চলছে, এমনকি তাদের সঙ্গে  কোন কথা বলতেই সরকারি দল অস্বীকার করে চলছে। এখন তারা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক মোর্চাকে বোকো হারাম, আইএস ও আল কায়েদা বানানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ মনে করেন এর লক্ষ্য বিদেশী রাষ্ট্র বিশেষ করে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভয় দেখানো। অনেকের মতে, সরকার এই ক্যাম্পেনে সফল হতে চায়। তারা তাহলে দুটো সুবিধা পাবে। প্রথমত ‘‘জঙ্গিদের’’ বাক-স্বাধীনতা স্বীকৃত নয়। নির্বাচন দিলে কথিত জঙ্গি আসতে পারে, তাই নির্বাচনের জন্য বিদেশীরা যাতে চাপ না দেয়। তবে নাগরিক সমাজের উদ্যোগ গোড়াতেই মুষড়ে পড়ার পর অনেকেই বিদেশীদের দিকে নজর রাখছেন। কারণ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, রাজনীতিকরা নিজেদের পক্ষে গেলে বিদেশী হস্তক্ষেপে কোন আপত্তি করে না। কিন্তু বিপক্ষে গেলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব  খোয়ানোর দোহাই দেন। তবে নাশকতার দায়ে প্রবল চাপে থাকা বিরোধীদলীয় মোর্চা নির্দিষ্টভাবে আন্তর্জাতিক ও বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে।
উল্লেখ্য যে, এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তর স্মরণ করিয়ে দেয় যে, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিরীহ নাগরিক ব্যাপকভাবে হত্যা করা হলে তার বিচার হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে হতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, নাশকতার ঘটনাবলী আইসিসি আইনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে। কারা  পুড়িয়ে ও নাশকতা করে মানুষ হত্যা করেছে, কেউ তার দায় স্বীকার করছে না। বিবদমান পক্ষগুলো সাফাই বক্তব্য রাখছেন। যদিও ক্রসফায়ারে নিহত ৩০ জনের পরিবার দাবি করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা তাদের হত্যা করেছে।
সরকার মতপ্রকাশের অধিকার স্বীকার করে। সভা-সমিতির আয়োজনে কোন বাধা-নিষেধ নেই। এরকম কথা বাংলাদেশ রাজনীতিতে আগে ক্ষমতাসীন সরকার বাস্তবে না হলেও বক্তৃতা-বিবৃতিতে সব সময় উচ্চারণ করতো। কিন্তু এরও পরিবর্তন ঘটেছে। সরকার এখন বিএনপির বাক-স্বাধীনতার কথা পারতপক্ষে উচ্চারণ করে না। অনেকের মতে এর অন্যতম কারণ বিএনপিকে তারা দক্ষিণ এশিয়ার আইএস হিসেবে চিত্রিত করতে চায়। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই শাসক দল ও তার মিত্ররা কমবেশি এই চেষ্টাই করে চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পশ্চিমা জগতের বোধগম্য উদ্বেগকেও তারা ওই একই পাল্লায় মাপতে চাইছে। কিন্তু এধরনের চেষ্টার কারণে মুসলিম মেজরিটি হয়েও দেশের যে মডারেট ভাবমূর্তি রয়েছে তা বিপন্ন হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
অনেক পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন যে, বাংলাদেশে সঙ্কট প্রলম্বিত হতে পারে। কারণ আপাতত সরকার সংলাপে যাবে না। বিএনপিও কর্মসূচি তুলে নেবে না। কেউ বলেন, কোন কারণে তারা একটা বিরতিতে গেলেও দ্রুত আবার তারা রাজপথের আন্দোলনে ফিরে আসবে। তাই জোর বিপদের মধ্যে বিবিসি ও ভোয়ার খবর শোনার হিড়িক পড়ার অতীত দিনগুলোর কথা মানুষ মনে করতে শুরু করেছে।
জন কেরি মেপে মেপে বলেছেন, তারা বাংলাদেশকে গণতন্ত্রে ‘‘ফিরতে’’ সাহায্য করতে চায়। কারো মতে তার সরল অর্থ দাঁড়ায়, দেশে গণতন্ত্র নেই। আবার তারানকো ‘যথাযথ পদক্ষেপ’ নেয়ার কথা বলেছেন।
কিন্তু  অবরোধের ৪৯তম দিবসের বাস্তবতা হলো, সংলাপ হবে না। সমস্যাও মিটবে না।

No comments

Powered by Blogger.