না দেখা বাবার জন্য অশ্রুপাত- পিলখানা ট্র্যাজেডির ৬ বছর

শীল কড়ই গাছের চূড়ায় তখন সকালের নবীন সূর্য। মধ্য ফাল্গুনের বাতাসে রয়ে গেছে মৃদু শীতের আমেজ। বনানীর সামরিক কবরস্থানে সি্নগ্ধ দিনের এই সূচনায় মিশে ছিল বিষাদের সুর। মায়ের সঙ্গে আসা ছয় বছরের শিশু সাদাকাত গিয়ে দাঁড়াল বাবার কবরের পাশে। তার জন্মের ১১ দিন আগে বাবা মেজর মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম সরকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নিহত হন। ছোট্ট শিশুটির কাছে তাই বাবা শুধুই একটি ছবি। তার কাছে বাবা মানে মায়ের মুখে শোনা কিছু গল্প। তবু সেই বাবার জন্য তার বুকে জমা অসীম ভালোবাসা। কবরের পাশের স্টিলের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে সে ফুল ছড়াচ্ছিল বাবার কবরে। অদেখা বাবার জন্য চোখের কোণে চিকচিক করছিল দু'ফোঁটা অশ্রু। গতকাল বুধবার সকালে তারই মতো ব্যথাতুর হৃদয় নিয়ে পিলখানা হত্যাযজ্ঞে নিহত স্বজনদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতে হাজির হয়েছিলেন অনেকেই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তারা জানান, তাদের ক্ষতি পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েই পূরণ হওয়ার নয়। প্রিয়জনের খুনিদের শাস্তি কার্যকর হলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাবেন তারা।
পিলখানা হত্যাযজ্ঞের দুঃসহ স্মৃতির ষষ্ঠ বার্ষিকী ছিল গতকাল বুধবার। দিনটি স্মরণে সকাল ৯টায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শুরুতেই রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবুল হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বীরবিক্রম নিহতদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এর পর পরই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা জানান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভঁূইয়া, নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল এম ফরিদ হাবিব, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারী ও বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। তা ছাড়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও দলের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান।
পরে বিএনপি ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) পক্ষ থেকেও নিহতদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। তখন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা স্যালুট দেন। শেষে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। দিনটি উপলক্ষে সব সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে কোরআন খতম, আত্মার মাগফিরাত কামনা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন ছিল।সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিকতার পর অপেক্ষমাণ স্বজনরা যান প্রিয়জনের কবরের কাছে। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের কারও মা, কারও স্ত্রী, কারও সন্তান এসেছিলেন বেদনাবিধুর দিনটিতে কবর জিয়ারত করার জন্য।মেজর মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম সরকারের স্ত্রী সানজানা জোবায়দা সোনিয়া এসেছিলেন তার ছেলে সাদাকাতকে নিয়ে। তিনি সমকালকে বলেন, 'স্বজন হারানোর যন্ত্রণা তো প্রকাশ করা যায় না। সাদাকাত এখনও ছোট, তাই ভালো করে বোঝে না। তবু সে খুব বাবার অভাব বোধ করে।'
মেজর মিজানুর রহমানের বৃদ্ধ মা কোহিনূর বেগম সমকালকে বলেন, মা বেঁচে থাকতে সন্তান মারা গেলে তার কোনো সান্ত্বনা হয় না।'কর্নেল কাজী মোয়াজ্জেম হোসেনের মা মোমেনা খাতুন জানান, 'সন্তানের খুনিদের মৃত্যুদণ্ড তিনি জীবদ্দশাতেই দেখে যেতে চান।'লে. কর্নেল লুৎফর রহমান খানের কবরে হলুদ আর লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছিল তিন ভাতিজা নেবরাজ, তানজিব ও ইশরাক। তাদের বয়স পাঁচ থেকে সাত বছর। লুৎফর রহমানের শাশুড়ি ফাতেমা রহমান জানান, অসুস্থ থাকায় তার মেয়ে আসতে পারেননি।
রায় কার্যকরে সরকার আন্তরিক :শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের রায় দ্রুত কার্যকর করতে সরকার আন্তরিক। বিদ্রোহে জড়িতদের অনেকের ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। আপিল নিষ্পত্তি ও অন্যান্য বিচারিক কার্যক্রম শেষে দ্রুতই রায় কার্যকর হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।বিদ্রোহের বিচারকাজ উন্মুক্ত করার দাবি বিএনপির :বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে ওই ঘটনার বিচারকাজ দেশবাসীর সামনে উন্মুক্ত করারও দাবি জানিয়েছে দলটি।

No comments

Powered by Blogger.