এক রায়ে বদলে গেল ৩ লাখ মানুষের ভাগ্য

১৪ জুন ২০১৪ ঢাকার মিরপুরে কালসি ক্যাম্পের উর্দুভাষীদের সঙ্গে স্থানীয়
বাঙালিদের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে ঘরে দেওয়া আগুনে পুড়ে নয়জন এবং
গুলিতে একজন মারা যায়। এ নিয়ে মিরপুর ও মোহাম্মদপুর অঞ্চলের
বিহারিদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। বিহারিদের অভিযোগ,
ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার মদদ আছে।
ঢাকার জেনেভা ক্যামেপ রোববার বিকালটা ছিল একটু ঠাণ্ডা। স্থানীয় উর্দুভাষী বাসিন্দাদের (বিহারি) ছোটখাটো এক জটলার সবাই একসঙ্গে বড় পর্দায় দেখছে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। অনেক বালকের গালে ও বুকে পাকিস্তানের পতাকা আঁকা। অতীতের রক্ত এখনও হয়তো তাদের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর হাজারো উর্দুভাষী বিহারি ভারত থেকে চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদের অনেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। ফলে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর এদের অনেকেই বাঙালিদের রোষানলে পড়ে। তখন সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংঘর্ষ রোধে বিহারিদের আবাস হয় বিভিন্ন ক্যামেপ। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১৬টি ক্যামেপ এ উর্দুভাষী মানুষদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৫১ হাজারে। এছাড়া ক্যামেপর বাইরে বাস করছিল আরও ১ লাখ বিহারি, তাদেরও কোন  নাগরিকত্ব ছিল না। তবে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে বদলে যায় তাদের জীবন, অবসান ঘটে তাদের নাগরিকত্বহীন অবস্থার। এদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। ইউএনএইচসিআর-এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র জেনেভা ক্যামেপই রয়েছে ৩০ হাজারের মতো বিহারি। রোববার সবাই যখন সেখানে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ উপভোগে মগ্ন, তখন দুই নারী নিজেদের কাজ করে যাচ্ছিলেন। নাহিদ পারভিন ও শাবনাজ আকতার নামের ওই দুই বিহারি তরুণীর হাতে রয়েছে বাংলাদেশে তার জাতিগোষ্ঠীর বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাবি। তারা দু’জনই আইন বিষয়ে স্বল্প প্রশিক্ষিত। খালিদ হুসেইন নামের এক উর্দুভাষী বিহারির প্রতিষ্ঠিত আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠানে তারা কাজ করেন। খালিদ হুসেইন বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্যামেপ বসবাসরত বিহারিদের মধ্যে প্রথম আইনজীবী। ক্যামেপ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে, একটি বাংলা মাধ্যমিক সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। তার সব বন্ধু ঝরে গেলেও, খালিদ সহ চারজন মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া শেষ করতে পেরেছিলেন। ১৯৯৯ সালে নিজের বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন অ্যাসোসিয়েশন অব  ইয়াং জেনারেশন অব উর্দু-সিপকিং কমিউনিটি। এরপর বিহারিদের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব প্রাপ্তি নিয়ে কাজ শুরু করেন খালিদ। ২ বছর পর তিনি সহ ১০ উর্দুভাষী বিহারি নিজেদের নাগরিকত্ব চেয়ে রিট পিটিশন করেন। ২০০৩ সালে দেয়া রায়ে তাদের নাগরিকত্বের আবেদন মঞ্জুর করা হলো। একইসঙ্গে সরকারকে আদালত নির্দেশ দিলেন, ভোটার তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্তি করতে। খালিদ হুসেইন ও তার সমপ্রদায়ের জন্য ওই রায় ছিল মাইলফলকের মতো। তার ভাষায়, ওই রায়ই আমার জীবন পরিবর্তিত করে দিয়েছে। ওই রায়ের পর ইউএনএইচসিআর সকল পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। ২০০৮ সালে, সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন যে, সকল উর্দুভাষী বাসিন্দা বাংলাদেশের আইনানুসারে এদেশের নাগরিক। তাদের নাম ভোটার তালিকায় নিবন্ধন করতে সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তারা পায় জাতীয় পরিচয় পত্র। এর ফলে প্রায় ৩ লাখ উর্দুভাষী বিহারির নাগরিকত্বহীনতার অবসান ঘটে। বাংলাদেশের এ ঘটনাটি এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকায় ইউএনএইচসিআর-এর সমস্যা সমাধানের সাতটি আদর্শ ঘটনার একটি হিসেবে স্থান পেয়েছে। খালিদ হুসেইনের আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠানটি ছয়টি শাখার মাধ্যমে বিহারিদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে। এর মধ্যে রয়েছে, তাদের জন্ম নিবন্ধন, পাসপোর্ট, ট্রেড লাইসেন্স ও আইডি কার্ড পেতে সহায়তা করা। সেখানেরই একজন কর্মী নাহিদ পারভিন জানালেন, পড়াশুনার পাশাপাশি এখানে কাজ করেন তিনি। তার বাঙালি বন্ধুরা একে অন্য চোখে দেখে না। তার ভাষায়, তিনি কখনই উর্দুভাষী হিসেবে বৈষম্যের শিকার হননি। তবে এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। অনেক উর্দুভাষী বিহারিই অত্যন্ত দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করেন। অনেক সময় মৌলিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হন তারা। তাদের ক্যামেপ সে সেবার অপ্রতুলতা ও প্রয়োজনীয় আইনি মানদণ্ড পূরণ করতে না পারা এর মূল কারণ।

No comments

Powered by Blogger.