বছরের পর বছর বিল দিচ্ছেন না শত শত বিদ্যুৎ গ্রাহক by রফিকুল বাসার ও নাহিদ তন্ময়

আ. মালেক মিয়া, মো. লুৎফর রহমান কিংবা সরদার স্টিল রি-রোলিং মিল_ বিদ্যুতের এসব গ্রাহক খুবই সৌভাগ্যবান। কারণ তাদের কোনো বিল দেওয়া লাগে না। বছরের পর বছর বিনা খরচে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। যদিও তারা সরকারিভাবে কোনো সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নন। কেউ পাঁচ বছর, কেউ আট বছর কিংবা ১২ বছর ধরে বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছেন না। অথচ কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। শুধু এই ক'জনই নন, এমন সৌভাগ্যবানের সংখ্যা অনেক। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর বকেয়া গ্রাহকদের তালিকা পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, সরকারি নিরীক্ষা বিভাগের প্রতিবেদনেও এমন বকেয়া থাকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সন্ধান মিলেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। চলতি মাসের হিসাবেও দীর্ঘদিনের খেলাপিদের বিদ্যুৎ সংযোগ ও বকেয়া দুটোই বহালতবিয়তে থাকতে দেখা গেছে। সংশ্লিষ্ট অফিসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে তাদের অনিয়মিতভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হয়। বকেয়া থাকার অভিযোগে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। ছয় মাস, চার মাস এমন কি তিন মাসের বকেয়া থাকার কারণেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। অথচ সৌভাগ্যবানরা ১২ বছর বকেয়া রেখেও বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চলেছেন। কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন কিংবা কোনো শাস্তির আওতায় আসছেন না। আবাসিক, শিল্প, বাণিজ্যিক সব শ্রেণীর গ্রাহকের মধ্যে এমন খেলাপি রয়েছে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বকেয়া থাকা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বকেয়া থাকার কারণে ডিসেম্বর মাসে ৫১ হাজার ৬৫৮টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যাদের কাছে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে চার হাজার ৬২৫ কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আছে।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ময়মনসিংহের ৭৭১০৯০৮৭ নম্বর গ্রাহক আ. মালেক। তিনি ৬৪ মাস ধরে বিল শোধ করেন না। ৬২ মাস ধরে বিল দেন না ৭৭৩৩১৫৪৬ নম্বর গ্রাহক মো. লুৎফর রহমান। ৬১ মাস বিল দেন না মো. হাবিবুর রহমান অথবা মো. রিউন মিয়া। ৩৩০২৪২ নম্বর হিসাবের গ্রাহক এসএ আলীম চৌধুরী। তিনি ৪৯ মাস টানা বিদ্যুৎ বিল দেন না। তার কাছে বকেয়া দুই লাখ ৫৬ হাজার ৬৫৫ টাকা। ৩৫০৬৭২ নম্বর হিসাবের গ্রাহক মো. সোলেমান আলীর কাছে ৪৩ মাসের বিপরীতে বকেয়া এক লাখ ৬০ হাজার ১৪৬ টাকা। তারা সবাই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) গ্রাহক।
বিউবো মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) আবদুর রউফ সমকালকে বলেন, বকেয়া আদায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন অভিযান চলছে। ১৮টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সারাদেশে এই টাস্কফোর্স বকেয়া আদায়ে অভিযান শুরু করবে।ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের ১৪৭৩০৭০৯ নম্বর গ্রাহক সরদার স্টিল রি-রোলিং মিল। জানুয়ারি মাসে তার বকেয়ার পরিমাণ ছিল এক কোটি ৮৫ লাখ ১১ হাজার ৩৮৬ টাকা। কয়েক মাস গড়ে তার প্রতি মাসে বিল হচ্ছে এক লাখ ২৪ হাজার ৪০৪ টাকা। এই হিসাবে এই সৌভাগ্যবান ১৪৮ মাস বা ১২ বছর বিল শোধ করেন না।ডিপিডিসির পরিচালক (অপারেশন) রমিজউদ্দিন সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতদিনের বকেয়া থাকার বিষয়টি জানা নেই। কোথাও কোনো ভুল হতে পারে। এটা স্বাভাবিক নয়। যদি কারও এমন থেকেও থাকে তবে তার বিরুদ্ধে খুব দ্রুত সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বকেয়া আদায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন অভিযান অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান। ডিপিডিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সুদসহ বকেয়া হিসাব করা হয়েছে বলে টাকার অঙ্ক বা মাস হিসাবে বেশি মনে হচ্ছে। তবে এসব গ্রাহকের বিরুদ্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৯৫ মাস বা প্রায় আট বছর বিদ্যুৎ বিল শোধ করেন না ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) বরিশালের গ্রাহক আ. মালেক মিয়া। তার গ্রাহক হিসাব নম্বর ই/২৪০০৯৪৮। মো. ফেরদৌস ওয়াহিদ, গ্রাহক নম্বর ই/২৪০১৬৭৪। বিদ্যুৎ বিল দেন না টানা ৫৯ মাস।এ ধরনের উদাহরণ অনেক। মাসের পর মাস নয়। বছরের পর বছর বকেয়া থাকছে। চোখের আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন এসব সৌভাগ্যবান। সংশ্লিষ্ট বিতরণ অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এসব গ্রাহক বকেয়া পরিশোধ করেননি।
কীভাবে একজন গ্রাহক এভাবে দীর্ঘদিন বিল না দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলেন জানতে চাইলে ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এতদিন বিল না দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা অবৈধ। এভাবে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। বকেয়া আদায়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অনেকটাই আদায় হয়েছে। ভবিষ্যতে পুরোটা আদায় করা হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে এবং যারা দীর্ঘদিন বকেয়া রাখতে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ এবং বিদ্যুতের মূল্যহার ও নিয়মাবলি উপেক্ষা করে অনেক গ্রাহক দীর্ঘদিন বকেয়া বিদ্যুৎ বিল শোধ করছেন না। সংশ্লিষ্ট অফিসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে তাদের অনিয়মিতভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এবং অনিয়মে যথাসময়ে খেলাপি গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। উল্টো তাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটিতে জমা দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় কমিটিতে জমা দেওয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রাহকের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং- বিজ্বাখস/৮১ (তাং ১১-৯-২০০২) অনুযায়ী দুই মাসের বেশি বিদ্যুৎ বিল অনাদায়ী থাকলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং বকেয়া বিল আদায় করতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুতের মূল্যহার এবং নিয়মাবলি ১৯৮৯-এর ২৪.২.১ এবং ২৪.২.২ অনুযায়ী গ্রাহক যথাসময়ে বিদ্যুৎ বিল শোধে ব্যর্থ হলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং বকেয়া আদায় করতে হবে। ট্যারিফ বিধি ১৯৮৯-এর ধারা ৩১.১ অনুযায়ী জামানত থেকে বকেয়া সমন্বয় করতে হবে। নিরীক্ষা অধিদপ্তর দাবি করেছে, কোটি টাকা বকেয়া পড়ে থাকলে গ্রাহকের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের ক্ষেত্রে এসব আইন অনুসরণ করা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.