গণপিটুনিতে নিহতরা গুলিতে ঝাঁঝরা -বিচারহীন হত্যার মিথ্যা গল্প বন্ধ করুন

পুলিশ দাবি করেছিল গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে তিন যুবকের। একজন মারা গেছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’। কিন্তু আলামত দিচ্ছে ভিন্ন তথ্য। নিহত চার যুবকের শরীরই ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। কারো গায়ে ২১টি, কারো গায়ে ১৬টি গুলির চিহ্ন। গায়ে নির্যাতনের দাগ। যে এলাকায় যুবকদের গণপিটুনি দিয়ে হত্যার দাবি করেছে পুলিশ ওই এলাকার স্থানীয়রাই জানেন না কথিত ওই গণপিটুনির কথা। উল্টো তারা জানিয়েছেন যে, ওই এলাকায় রাতে তারা অনেক গুলির শব্দ শুনেছেন। রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া ও টেকনিক্যাল মোড় থেকে উদ্ধারকৃত চার যুবকের একজন আবদুল ওয়াদুদ ব্যাপারী (৩০) কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন বলে স্বীকার করে পুলিশ। বাকিদের গণপিটুনিতে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছিল রোববার রাতেই। তাদের ব্যাপারে হাসপাতালে লাশের সুরতহাল রিপোর্টে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য। এ তিন যুবকের শরীরে ছিল অসংখ্য বুলেটের চিহ্ন। নিহত সুমন, জুয়েল ও রবিনের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তিনজনের মধ্যে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এ তিনজনের মধ্যে একজনের শরীরে ২১টি, একজনের ১৮টি ও অপর একজনের শরীরে ১৬টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ওয়াদুদের শরীরে ছিল ছয়টি গুলির চিহ্ন। রাতে রাজধানীতে চার যুবকের লাশ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টার মাথায় ঝিনাইদহে কথিত বন্দুকযুদ্ধে বিএনপির দুই কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশের তথ্য অনুসারে গণপিটুনিতে ও বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের ব্যাপারে এই বিবরণ একটি দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অংশ। এই রিপোর্টটি যে দিন প্রকাশিত হয়েছে, সেই একই দিনে রাজধানীসহ সারা দেশে ছয়টি গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সংবাদপত্রে খবর হিসেবে স্থান না পাওয়া আরো কতজন আটক ব্যক্তি লাশ হয়ে অজ্ঞাত হয়েছেন তার হিসাব নেই। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ সংখ্যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হিসাবের ১০ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন যে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে প্রতিদিনই লাশের সংখ্যা বাড়ছে। কেউ মারা যাচ্ছে পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে, কাউকে বাসাবাড়ি, কর্মস্থল অথবা রাস্তাঘাট থেকে ধরে নিয়ে লাশ করে দেয়া হচ্ছে। এভাবে কার সন্তান, কার বাবা বা স্বজন কখন লাশ হয়ে ফিরে আসবে, অথবা গুম হয়ে খোঁজখবরহীন হয়ে যাবে তার কোনো হদিস নেই। কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এ রকমটি দেখা যায়। বাংলাদেশ যেন আজ যুদ্ধবিধ্বস্ত এক মৃত্যুজনপদে পরিণত হয়েছে, যেখানে শুধু স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই তা-ই নয়; বরং লাশটি যে জানাজা বা দাফনের সুযোগ পাবে তারো কোনো গ্যারান্টি নেই।
এ অবস্থা কোনো স্বাধীন দেশের জন্য কাম্য হতে পারে না। এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধ, গণপিটুনি বা ট্রাকের নিচে পড়ে মৃত্যুর যে কাহিনী প্রতিদিন বলা হচ্ছে, সেটাকে কেউ এখন আর বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে না। এই অসত্য কাহিনী বন্ধ করা প্রয়োজন। এভাবে ১৬ কোটি মানুষের একটি দেশকে মৃত্যুজনপদ বানানো থেকে কে লাভবান হবে? কেউ কবরের নিস্তব্ধতা নামিয়ে শান্তি ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে এখান থেকে সে-ই কেবল লাভবান হতে পারে। বলার প্রয়োজন নেই সে পথ ভয়ঙ্কর, সেটি কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না।

No comments

Powered by Blogger.