মানসিকভাবে প্রস্তুত খালেদা জিয়া by কাফি কামাল

গ্রেপ্তার, কারাবরণসহ যে কোন ধরনের পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া। চলতি বছরের ৩রা জানুয়ারি থেকে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ দিন কাটাচ্ছেন তিনি। পড়ছেন একের পর এক প্রতিবদ্ধকতার মুখে। প্রতিদিনই পাচ্ছেন মামলা-হামলা দুঃসংবাদ। এমন প্রতিকূল সময়ে ছেলেকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান তিনি। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তার কার্যালয়ে অবস্থানরতদের খাবার সরবরাহ করতে দিচ্ছে না পুলিশ। কিন্তু আন্দোলনের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়েননি খালেদা জিয়া। সর্বশেষ তিনি পেলেন দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবর। বিশেষ আদালত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গতকাল দুপুরে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আইনজীবীদের কাছে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গুলশান কার্যালয়ে ছুটে যান তার ভাই সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরীন এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। তারাই প্রথম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি জানান। কার্যালয়ে অবস্থানকারী সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানার খবরটি স্বাভাবিকভাবে নেন খালেদা জিয়া। কার্যালয়ে অবস্থানকারী নেতারা তার কাছে যান। তিনি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা কি চিন্তিত? আমি চিন্তিত নই। রাজনীতির ইতিহাসে এমন প্রতিহিংসার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ব্যক্তিগতভাবে জেল-জুলুমও আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কাঙ্ক্ষিত সমাধান না আসা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। চলমান আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। আরও অনেক কষ্ট করতে হবে। আপনারা কি কষ্ট করতে পারবেন? এ সময় নেতারা হাসিমুখে তাকে সায় দেন। খালেদা জিয়া নেতা ও তার কর্মকর্তাদের সাহস ও সান্ত্বনা দেন। কিছু নির্দেশনাও দেন। দীর্ঘ পৌনে দুই মাস ধরে অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে তার সঙ্গে অবস্থান করায় নেতা ও কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান। সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবর পেয়ে খালেদা জিয়া দেশে-বিদেশে কয়েকটি ফোন করেন। এ ছাড়া কার্যালয়ে অবস্থানকারী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানও বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি ফোন করেন। এদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবর পেয়ে গুলশান কার্যালয়ে ছুটে যান তার বড় বোন সেলিনা ইসলাম। এরপর থেকে পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার সঙ্গেই অবস্থান করছেন। এদিকে চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, গুলশান কার্যালয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া ব্যারিকেডে অবরুদ্ধ হওয়ার গ্রেপ্তার ও কারাবরণসহ যে কোন ধরনের পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন খালেদা জিয়া। ৬ই ফেব্রুয়ারি দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া নিজেই বলেছেন, আমি সকলকে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই- কোন অনৈতিক চাপ বা ভীতির মুখে আমি নত হবো না ইনশাআল্লাহ্‌। যে কোন পরিস্থিতি বা পরিণতির জন্য আমি তৈরি আছি। এছাড়া বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের পক্ষে দেয়া একাধিক বিবৃতিতেও খালেদা জিয়ার এ ত্যাগ-স্বীকারের অঙ্গীকার ও যে কোন পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত বলে দাবির করা হয়। উল্লেখ্য, ৩রা জানুয়ারি থেকে ২৫শে ফেব্রুয়ারি। নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ৫৩ দিন কেটে গেছে খালেদা জিয়ার। চলাফেরার সীমাবদ্ধতা, ঘুম ও বিশ্রামের অসুবিধা, যোগাযোগ বন্ধ এবং গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিয়েই কার্যালয়ে অবস্থান করছেন তিনি। প্রথম ১৬ দিন ছিলেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া ব্যারিকেডে অবরুদ্ধ। তারপর কার্যালয়ের অবরোধ তুলে নেয়া হলেও কৌশলগত কারণে কার্যালয় ছেড়ে যাননি তিনি। দৃশ্যত অবরোধ তুলে নেয়া হলেও তার কার্যালয় ঘিরে অব্যাহত রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে কার্যালয়ে লোকজনের যাতায়াতে। এ সময়ের মধ্যে ৫ই জানুয়ারি পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে কার্যালয় থেকে বের হবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবন্ধকতার কারণে বের হতে পারেননি তিনি। উল্টো পুলিশের ছোড়া পেপার স্প্রেতে অসুস্থ হয়েছেন। ২৪শে জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। ছেলের শোকে যখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তখন অবরোধের সময়ে বাসে পেট্রল বোমা হামলা ও হত্যার ঘটনায় তাকে হুকুমের আসামি করে দায়ের করা হয়েছে অন্তত অর্ধ ডজন মামলা। কার্যালয় ঘিরে পুলিশের উপস্থিতিতেই দিনের পর দিন ঘেরাও-বিক্ষোভ-মিছিল করছে সরকারদলীয় বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, পেশাজীবী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে ৩০শে জানুয়ারি শেষ রাতে কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, কেবল টিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় সরকার। কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর খালেদা জিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দেন যত কিছুই হোক কার্যালয় ছাড়বেন না। নানা মহলের সমালোচনার মুখে ১৯ ঘণ্টা পর তার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ ও আশপাশের দূতাবাসগুলোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১১দিন পর মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ দেয়া হয়। পরদিন ৩রা ফেব্রুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে। একপর্যায়ে ওই সংগঠনের মফিজুল নামে এক নেতা পিস্তল হাতে কার্যালয়ের দিকে ছুটে যান। এ সময় তিনি খালেদা জিয়াকে গুলি করার হুমকি দেন। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তাকে হুকুমের আসামি করে কুমিল্লা, পঞ্চগড়, খুলনাসহ কয়েকটি জায়গায় মামলা দায়ের করে পুলিশ। ১০ই ফেব্রুয়ারি বিকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গুলশান কার্যালয়ে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। এদিকে ১১ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য নেয়া খাবার ভ্যানটি ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। সেই সঙ্গে কড়াকড়ি আরোপ করা হয় কার্যালয় ঘিরে। অবশ্যই ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই কার্যালয়ের গেটে একটি টেবিল ও খাতা-কলম নিয়ে বসে স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যরা। কার্যালয়ের যাওয়ার সময় তারা নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর লিখে তারপর ঢোকার অনুমতি দেয়া হতো। ১১ই ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে কোন খাবার নিতে দিচ্ছে না পুলিশ। এ সময় দিনের পর দিন দফায় দফায় খাবার ফিরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এতে খাবার সঙ্কটে পড়েন তার কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভুক্ত থাকায় একাধিক দিন উপোস থেকেছেন খালেদা জিয়া নিজেও। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে তার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন এবং একাধিক দিন কার্যালয়ের আশপাশে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। সবশেষে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গতকাল বিশেষ আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবরটি পান খালেদা জিয়া।

No comments

Powered by Blogger.