প্রকাশনার শিকড় ও শিখর by খান মাহবুব

বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার আর্থিক অগ্রগতির সূচক শল্গথ হলেও মানবিক অগ্রগতির সূচক শল্গথ নয়। প্রকাশনা জগৎ অনেক লেখকের লেখা বইকে পাঠকপ্রিয়তা দিয়েছে। পাঠের প্রেরণার পাশাপাশি প্রকাশনা জগতের ব্যবস্থাপনার মধ্যে আধুনিক ধ্যান-ধারণা প্রয়োগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে প্রকাশনা জগতের আয়োজন অতিমাত্রায় একুশের বইমেলাকেন্দ্রিক। প্রকাশনার তোড়জোড় বছরব্যাপী চললে বাঙালির জাতীয় চালচিত্রের ক্যানভ্যাস বিস্তৃত হবে। প্রকাশনাকে শিল্পের মর্যাদা দিতে এ খাতের কুশীলবদের দাবির উচ্চকণ্ঠ থাকলেও শিল্পের মর্যাদা নিতে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরালো নয়। এখনও দেশে প্রকাশনা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠদানের কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারও বিবৃতি-বক্তৃতায় যতটা আগ্রহী কার্যক্ষেত্রে ততটা নয়। সম্প্রতি চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সরকার ৩ শতাংশ সুদে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের ব্যবস্থার প্রণোদনা নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সৃজনশীল প্রকাশনার খাতকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে সরকারকে ১৯৯২ সালে প্রণীত গ্রন্থনীতি সময়োপযোগী করে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে দ্রুত এ খাতের উন্নয়নের কাজ করতে হবে। দুঃখের বিষয়, সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে সুকুমার শিল্পের পরিতোষণে প্রণোদনার তাগিদ সত্ত্বেও সরকার বছরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাত্র দুই কোটি টাকার সৃজনশীল বই ক্রয় করে।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় প্রকাশনা ব্যবসা হিসেবেও এখন ছোট কোনো খাত নয়_ সমগ্র বিশ্বের প্রকাশনা শিল্পের বার্ষিক ১০০ কোটি বিলিয়ন ডলারের আর্থিক মূল্যে আমাদের প্রকাশনার ভূমিকা কী? প্রতিবেশী ভারত যেখানে ৮০টি দেশে বই রফতানি করে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি ডলার উপার্জন করে, সেখানে আমাদের উপার্জন কী? প্রতিবেশী ভারতে নানামুখী প্রণোদনার ব্যবস্থা আছে সরকারের তরফ থেকে। এমনকি ভারতে উৎপাদিত সৃজনশীল বইয়ের একটি বড় অংশের ক্রেতা ভারত সরকার। ফলে ভারত আজ অভ্যন্তরীণ বাজারে অবস্থান দৃঢ় করে বহির্বিশ্বে প্রকাশনার রফতানি খাতকে মজবুত করছে। ভারতে ১৯০০০ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বছরে গড়ে এক লাখের মতো বই প্রকাশ করে চলেছে। ইতিমধ্যে ভারতের প্রকাশনার অগ্রগতিতে চিন্তিত বিশ্বে প্রকাশনার জগতের প্রথম কাতারের দেশ চীন। চীনে প্রতি বছর ৮০০ কোটি কপি বই প্রকাশ হয়। ২০১৫ সালে বৈশ্বিক পুস্তক প্রকাশনা শিল্পে আর্থিক মূল্য ১১৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। আমাদের উদ্যমী তরুণ-তরুণীরা কেন এ বিশাল সম্ভাবনা থেকে দূরে থাকবে? বর্তমানে আমাদের প্রকাশকরা বছরে মাত্র ৪০০০ টাইটেল বই প্রকাশ করেন।
পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও মানুষের চিন্তার পরিবর্তনেও কাগজের বইয়ের উপযোগিতা এখনও হুমকির মুখে পড়েনি। যদিও আমরা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আওতার পথে হাঁটছি, তবু কাগজের বইয়ের শরীরী উপস্থিতিই বরং জরুরি। তারপরও আমাদের ই-বুক নিয়ে ভাবতে হবে। সামাজিক রেনেসাঁর মাধ্যমে জনগণের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির মাধ্যমে রিডিং সোসাইটি গঠন করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে প্রকাশনার উৎকর্ষের জন্যই।
বাংলাদেশে একুশে বইমেলা আমাদের একান্ত নিজস্ব। তার বাইরে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের কলকাতা বইমেলার মতো বড় পরিসরে বহুভাষিক বইমেলার আয়োজন প্রয়োজন। মুক্তবাণিজ্যের হাওয়ায় পাল তুলে প্রতিবেশী ভারতের বই ঢুকছে বাংলাদেশে। পাশাপাশি ভারতের পাইরেসি বইও চলছে অবাধে। ভারতে আমাদের প্রকাশনা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয় না বলে আমাদের বইয়ের বাজার সেখানে সংকুচিত। বাংলাভাষাকে বিশ্বময় করতে বাংলা প্রকাশনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সারাবিশ্বে। সৃজনশীল প্রকাশনার উন্নয়নে আমরা প্রযুক্তির সহযোগিতা কিংবা আধুনিকতার সংশেল্গষ যতই ঘটাই না কেন, আমাদের হাজার বছরের বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা মাথায় রাখতে হবে। কারণ বাঙালির প্রকাশনার ভিত এই মাটির সঙ্গে যুক্ত। সৃজনশীল প্রকাশনা তার পথচলায় '৫২-শহীদের স্বাক্ষর বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবচিহ্ন এঁকে এগিয়ে চলেছে।
mahbub.sahana@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.