প্রলম্বিত রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধিতে

প্রলম্বিত রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে দেশের রপ্তানি আর প্রবৃদ্ধিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৈরী  পোশাক শিল্প। বিঘ্নিত হচ্ছে সরবরাহ চেইন। সহিংসতা, আগুনে মারা যাচ্ছে  মানুষ। মারা যাচ্ছে ক্রসফায়ারেও। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, গত সপ্তাহে সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে শ্রমিকরা বিরোধী দল বিএনপি’র কার্যালয়ের চারদিকে আট ফুট উঁচু দেয়ালে কাঁটাতারের বেষ্টনী দিয়েছে। পরস্পর বিরোধী দুই শীর্ষ প্রধান রাজনীতিক এই দেশটির অনেকাংশকে অস্থিরতায় ফেলেছেন। রাজপথে সংঘর্ষ হচ্ছে। পেট্রলবোমা মারা হচ্ছে। গুলি হচ্ছে। এতে জানুয়ারির শুরু থেকে কমপক্ষে ৮০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি করেছে সম্প্রতি তার স্থিতিশীলতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিরোধী দলের কমপক্ষে ২০ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন এনকাউন্টারে। পুলিশ বলছে, এসব ক্রসফায়ার। কিন্তু মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, এগুলো বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিরোধ থেকে গত মাসে এই সহিংসতার সৃষ্টি। গত বছরের ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিরোধী দলগুলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগের মধ্যে পিছু হটার বা দাবি মেনে নেয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। একই অবস্থা তার দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ারও।  নেতাকর্মীদের হরতাল, সড়ক, রেল ও পানিপথে অবরোধ সৃষ্টির জন্য আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। তারা বলছেন, ভিন্ন মত প্রকাশের অন্য সব পথ সরকার বন্ধ করে দেয়ায় তাদের সামনে এছাড়া কোন বিকল্প নেই। বিরোধী দলের বেশ কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে জেলে ঢুকিয়েছে সরকার। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রকে প্রতীক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। তিনি তাদের সেই প্রচেষ্টাকে থামানোর জন্য লড়াই করছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেত্রীকে ‘খুনি ও সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে তার নিন্দা করেছেন শেখ হাসিনা। বিশৃঙ্খলা শুরুর পর থেকে পরিবহনে হামলায় কমপক্ষে ৫০ জনেরও মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী করেছেন বিরোধী দলকে। গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদেরকে অবশ্যই সন্ত্রাসীদের পরাজিত করতে হবে। এসব মৃত্যুর জন্য দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বিএনপি। উল্টো সহিংসতাকে উস্কে দিতে সরকারপন্থিরা স্যাবোটাজ করছে বলে অভিযোগ তাদের। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু এই দু’নেত্রীর মধ্যকার ব্যক্তিগত রেষারেষির ফলই সহিংসতা। এতে এ দেশটি গভীরভাবে বিভক্ত। ঢাকার নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক নূরুল আমিন বলেন, দু’পক্ষেই কট্টরপন্থা অবলম্বনকারী রয়েছেন। তারা ভাবছেন কোন সমঝোতাই সম্ভব নয়। আমরা যা দেখছি তা হলো ধ্বংসের রাজনীতি। যদিও বাংলাদেশ একটি উদার মুসলিম দেশ তবুও কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলাকে খাটো করে দেখা হলে তাতে কট্টরপন্থিদের বার্তা ব্যাপকভাবে গৃহীত হতে পারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় পাকিস্তান সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। তারাই এখন বিএনপি জোটের শরিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে অভিযুক্ত হয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর ৯ সদস্য। অন্যদিকে জামায়াত নেতারা বলছেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছেন তারা। তাই তারা ১৯৮০ এর দশক থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আসছিল। তবে ক্ষমতাসীন দল বলছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ভূমিকার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক বহু দিনের। শেখ হাসিনা ঘাতকের হাতে প্রাণ দেয়া বাংলাদেশী স্বাধীনতা যুুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। আর খালেদা জিয়া বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক বাংলাদেশী প্রেসিডেন্ট ও সেনা কমান্ডার জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। জিয়াউর রহমান কিছু সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হয়েছিলেন। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ সরকার প্রধান হিসেবে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় এসেছেন এ দু’নেত্রী। বাংলাদেশীরা প্রায়ই তাদেরকে ‘ব্যাটলিং বেগমস’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। স্থানীয় বাংলা ভাষায় ‘বেগম’ শব্দটি হলো বিবাহিত কোন নারীর প্রতি সম্মানজনক সম্বোধন। বিরোধী দলে থাকাকালীন হাসিনা ও খালেদা উভয়ই হরতাল-অবরোধসহ সহিংস প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারা এসব কৌশলকে সন্ত্রাসবাদ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলছেন, তাদের মুখোমুখি অবস্থানের রীতি আর পারস্পরিক আস্থাহীনতা এখন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রগতি পশ্চাৎধাবনের ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর জেনারেল সেক্রেটারি বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হাসিনা ও খালেদা দলীয় কর্তৃত্ববাদী হিসেবে কাজ করেছেন। তারা দেশকে দু’টি যুদ্ধরত পক্ষে বিভক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়েছে আর নাগরিক সমাজ বিভক্ত হয়ে গেছে। গত বছর ৫ই জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে সরকার বিরোধীদের প্রতিবাদ নিষিদ্ধ করলে বর্তমান সহিংসতার পালা শুরু হয়। কয়েক ডজন সিনিয়র বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর প্রায় দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয় থেকে বের হতে বাধা দেয়। পুলিশ বলে, তারা খালেদা জিয়ার জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা দিচ্ছিল। এ বিশৃঙ্খলা দেশের সরবরাহ চেইনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশটির বাৎসরিক ২৪০০ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক শিল্প। একটি শিল্প গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী ৩০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন কমে গেছে। চাপের মুখে ভেঙে পড়ছে অর্থনীতি। মুডি’স গত সপ্তাহে বাংলাদেশের জন্য ‘ক্রেডিট ডাউনগ্রেডের’ ইঙ্গিত দিয়েছে। তারা সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে, প্রলম্বিত রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে দেশটির রপ্তানি আর প্রবৃদ্ধিতে।

No comments

Powered by Blogger.