সশস্ত্র বাহিনীকে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মামলা : ১০ দিনের রিমান্ডে মান্না, আদালতে যা বললেন মান্না

সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিদ্রোহে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার মহানগর হাকিম মো. মাহবুবুর রহমানের আদালতে গুলশান থানার এসআই আবদুল বারিকের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই সঙ্গে তাকে বিধি ‍অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর আগে সোমবার মধ্যরাতে তুলে নিয়ে যাওয়ার ২১ ঘণ্টা পর থানায় হস্তান্তর করা হয় মান্নাকে। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে র‌্যাব সদস্যরা তাকে গুলশান থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র‌্যাব। তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিদ্রোহে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এ মামলায় মান্না ছাড়াও অজ্ঞাতনামা একজনকে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, মান্নার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৩১ ধারায় মামলা করা হয়েছে। এসআই সোহেল রানা মামলাটির বাদী। মামলায় গতকাল সন্ধ্যায় মান্নাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। গত সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে বনানীর একটি বাসা থেকে মান্নাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে একটি দল তাকে নিয়ে যায় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। পরিবারের লোকজন গতকাল দিনভর খোঁজ করেও জানতে পারেননি, তিনি কোথায় ছিলেন, কেমন ছিলেন।
দিনভর মান্নার খোঁজ পাওয়া না গেলেও রাত সাড়ে ১০টার দিকে আভাস পাওয়া যায় যে তাঁকে রাতের যেকোনো সময় থানায় হস্তান্তর করা হবে। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এদিকে পুলিশের রমনা, মতিঝিল ও গুলশান বিভাগের ১১ থানায় মান্নার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, নাশকতা, লাশ ফেলাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে পুলিশ ২৪টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। আর পরিবারের পক্ষ থেকে মান্নাকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বনানী থানায় একটি জিডি করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে মান্নার কথোপকথন নিয়ে গত সোমবার আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর রাত সাড়ে তিনটার দিকে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পক্ষে-বিপক্ষে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মন্ত্রী ও সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা গতকাল পৃথক অনুষ্ঠানে মান্নাকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি তোলেন। আর বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্যসহ কয়েকটি সংগঠন মান্নার খোঁজ না পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
এর আগে মান্নার স্বজনেরা জানান, ভাতিজির বনানীর বাসা থেকে সোমবার রাত সাড়ে তিনটায় নিয়ে যাওয়া হলেও গতকাল রাত পর্যন্ত তাঁরা মান্নার কোনো খবর জানেন না। মান্নাকে উদ্ধারে তাঁরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ ঘটনায় বনানী থানায় জিডি করেছেন মান্নার ভাবি বেগম সুলতানা। বনানী থানায় করা সুলতানার জিডিতে বলা হয়, রাতে কলাবাগানের বাসা থেকে মান্না তাঁর ভাতিজি শাহানামা শারমিনের বনানীর বাসায় যান। রাত সাড়ে তিনটার দিকে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে সাদাপোশাকের পাঁচ-ছয়জন লোক ওই বাসার সামনে গিয়ে নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দেন। বাসার লোকজন সকাল না হওয়া পর্যন্ত দরজা খুলতে অস্বীকৃতি জানান। আগত ব্যক্তিরা বলেন, ‘আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না।’ পরে দরজা ভেঙে ফেলার হুমকি দিলে একপর‌্যায়ে দরজা খুলে দেওয়া হয়। এরপর ভেতরে ঢুকে মান্নাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান তাঁরা।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মান্নার সঙ্গে খোকা ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কথোপকথনে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে দেশকে অস্থিতিশীল করা ও রাষ্ট্রদ্রোহের আভাস রয়েছে। এতে সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টিরও উসকানি ছিল।
নাগরিক ঐক্যের দাবি: গতকাল সকালে সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে মান্নার মুক্তি দাবি করা হয়। এই সম্মেলনে মাহমুদুর রহমানের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল।
নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির সঙ্গে দুটি টেলিফোন কথোপকথন ইন্টারনেটে প্রকাশিত হওয়ার পর নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য এই সংবাদ সম্মেলনের আহ্বান করেন মান্না।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা ইফতেখার আহমেদ লিখিত বক্তব্যে বলেন, মান্নাকে ডিবি পুলিশ বনানীতে তাঁর আত্মীয়ের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ আটকের কথা অস্বীকার করছে।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া: গতকাল এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সাদাপোশাকধারী সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই মান্নাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে বক্তব্য দেওয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। যে প্রক্রিয়ায় দেশের এই পর্যায়ের একজন নাগরিককে তুলে নেওয়া হলো, তাতে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং বেঁচে থাকার অধিকারের কোনো গ্যারান্টি অবশিষ্ট রইল না।’
আদালতে যা বললেন মান্না
আদালতে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, আমি অসুস্থ ব্যক্তি। আমার বয়স ৬৪ বছর। যে অভিযোগে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সে বিষয়ে আমি বলতে চাই, আমার বক্তব্য একপেশে করা হয়েছে। বাকি অংশটুকু বাদ দেয়া হয়েছে। বাকি অংশ পেলে বুঝতে পারবো, আসলে সরকার আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ এনেছে। আমাকে যদি জিজ্ঞাসাবাদই করতে হয় তবে যেন জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আদালত যদি আমাকে ১/২ ঘণ্টা টিভিতে বলার সুযোগ দেন তবে আমি বলতে পারব আমি কি বলেছি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা তা বুঝতে পারেন না। সেজন্য দেশবাসীর জানা উচিত আমি কি বলেছি।
মান্না বলেন, আমি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করি। তবে সহিংসতা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা সমর্থন করি না। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের কথা বলেছি তবে হত্যা বা সহিংসতার কথা বলেনি। গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলতে যা বুঝায় তাই আমি সমর্থন করি।
যে প্রবাসীর ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে, সেই প্রবাসী ব্যক্তি কে সরকার তার নাম সংগ্রহ করেনি। যা একপেশে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী বা বিমানবাহিনীর যে কর্মকর্তাদের কথা বলা হয়েছে তাদের নামও সরকার উল্লেখ করেনি। আসলে সবকিছুই একপেশে হয়েছে। আমি কোনো সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীর কর্মকর্তার সাথে কথা বলিনি। তিনি বলেন, তবে গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অগণতান্ত্রিক। যা দেশী-বিদেশী সবাই জানে। এ বক্তব্য দেয়ায় ক্ষোভে দু:খে ফেটে পড়েন সরকার দলীয় আইনজীবীরা। সেজন্য তারা তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারপরও মান্না তার কথা বলা বন্ধ করেননি। মান্না আরো বলেন, আমি সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র লিপ্ত নই। কোনো বাহিনীকে উস্কানী দেইনি। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, শান্তির কথা বলি।
মাহমুদুর রহমান মান্নকে বেলা ৩টা ১৫ মিনিটের সময় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতে গারদখানায় নিয়ে আসে। তখন আদালতে ব্যাপক সংখ্যক আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা তাকে করতালির মাধ্যমে অভিবাদন জানান। তারা বলতে থাকেন, মান্না তোমার ভয় নাই, আমরা আছি তোমার সাথে।
বেলা ৩ টা ১৮ মিনিটের সময কোর্ট গারদ (হাজত) থেকে আদালতে হাজির করা হলে সরকারপন্থী আইনজীবীরা তাকে বসতে দিতে রাজি ছিল না। তখন আইনজীবীরা আদালতে তার বসার বিষয়ে অনুমতি চাইলে আদালত বেঞ্চ থেকে কাঠগড়ার একটি টুল দেন বসার জন্য। তখন মান্না ওই টুলে আর বসেননি।সার্বক্ষণিক মান্না কাঠগড়ায় পাঞ্জাবী পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকেন।

No comments

Powered by Blogger.