যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন পেট্রলবোমায় দগ্ধ রশিদ by রোকনুজ্জামান পিয়াস

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট
এত কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না রশিদ। তাই সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছেন। দগ্ধ শরীর নিয়ে ১ মাস ৪ দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তিনি। কখনও চিত হয়ে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোন কিছুতেই মুক্তি মিলছে না তার। রশিদের এ যন্ত্রণাকাতর অবস্থা দেখে পাশেই অঝোরে কাঁদছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী। গতকাল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে চোখে পড়ে এমন আরও অর্ধশত দগ্ধ মানুষের আর্তনাদ। ভাবলেশহীন স্বজনদের করুণ চাহনি। দেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় এদের কারও হাত, কারও পা, কারও মুখ আবার কারও সারা শরীর ঝলসে গেছে পেট্রলবোমায়। দগ্ধদের কাতারে রয়েছেন ছেলে-বুড়ো-নারী। বাদ পড়েনি অবুঝ শিশুও। অগ্নিদগ্ধ হয়ে অনেকের চেহারায় বিকৃতি ঘটেছে। বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পার্থ শঙ্কর রায় বলেন, অবরোধ-হরতাল শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বার্ন ইউনিটে পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধ ১৪৫ জন ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে দগ্ধ ৪২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। তাদের কবে হাসপাতাল ছাড়তে হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না কেউ। এই ৪২ জনের মধ্যে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আশঙ্কাজনক এসব রোগীর বাড়ি চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও রাজধানীর শনির আখড়া এলাকায়। হাসপাতালের ৫ তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৩৮ জন চিকিৎসাধীন। টাঙ্গাইলের বাসিন্দা ট্রাকচালক উজ্জ্বল। তার স্ত্রী জানান, বুধবার বালিভর্তি ট্রাক নিয়ে তিনি ঢাকায় আসছিলেন। কিন্তু রাত ১টার দিকে বঙ্গবন্ধু ব্রিজ ছেড়ে আসতেই দুর্বৃত্তরা ট্রাকটি লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছোড়ে। এতে দগ্ধ হন তিনিসহ ট্রাকের হেলপার। মুখমণ্ডলসহ তার শরীরের ১৫ ভাগ অংশ পুড়ে গেছে। আর হেলপারের পুড়েছে শরীরের ৩০ ভাগ। এক অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বেডে পড়ে আছেন তারা। এদিক-ওদিক ঘুরাতে পারছেন না শরীর।  আত্মীয়স্বজন আসলে শুধু চোখ দু’টি ঘুরাচ্ছেন এদিক-ওদিক। উজ্জ্বলের নার্সারিতে পড়ুয়া ৬ বছরের একটি সন্তান রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী। টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকার আহসান হাবিব পলাশ। ৯ বছরের শিশু পলাশ তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ালেখা করে। বায়না ধরে মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল ঢাকার মধুবাগ এলাকায় বোনের বাড়িতে। কিন্তু দুর্বৃত্তদের ছোড়া বোমায় পুড়ে গেছে তার শরীর। পলাশের মা জানান, গত শনিবার সন্ধ্যার দিকে  বোন জামাইয়ের সঙ্গে বাজারে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ করেই একটি বোমা এসে পড়ে। হাত-পা দগ্ধ হয় ৯ বছরের পলাশের। যন্ত্রণায় কান্নাকাটি করছিল পলাশ।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের নিরঞ্জন। পেশায় গাড়ির মেকানিক। শরীরের ৪২ ভাগ পুড়ে গেছে তার। গত ১৯শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় একটি ট্রাক মেরামত করে সব ঠিকঠাক আছে কিনা পরীক্ষা করার সময় দুর্বৃত্তরা পেট্রলবোমা ছোড়ে। নিরঞ্জনের বাবা জানান, ১০ বছর আগে তার স্ত্রী মারা গেছেন। একমাত্র ছেলে নিরঞ্জনই তার সমস্ত পৃথিবী। তিনিই তার মা-তিনিই তার বাবা। ছেলের কথা চিন্তা করে তিনি দ্বিতীয় বিয়েও করেননি। আজ প্রায় দেড় মাস ধরে পড়ে আছেন এই হাসপাতালে। নিরঞ্জনের বাবা জানান, ১৯ তারিখে ছেলে গাড়ি নিয়ে বের হলে কে বা কারা পেট্রলবোমা মারে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীরের ৪২ ভাগ পুড়ে গেছে। ছেলেটি ছাড়া তার আর কিছু নেই- এ কথা বলতে বলতে চোখ ছলছল করে ওঠে তার। নিরঞ্জনের পেছনের বেডেই রয়েছেন গাজীপুর কালিয়াকৈরের আবদুর রশিদ। তার শরীরের ৪০ ভাগ পুড়ে গেছে। তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। আর বলছিলেন আল্লাহ আমার এতো কষ্ট কেন? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। এ সময় বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছিলেন। কখনও চিত হয়ে আবার কখনও হামাগুড়ি দিচ্ছিলেন। আর ব্যথায় কোঁকানো দেখে রশিদের স্ত্রী অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি জানান, পেশায় ভ্যানচালক তার স্বামী রশিদের রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই। আছে একমাত্র বোন। সেই বোনের স্বামী অসুস্থ শুনে ওইদিন দেখতে বেরিয়েছিলেন। ফেরার পথে পেট্রলবোমার শিকার হন। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তিনি আরও বলেন, একটি অটোমিলের ভাড়ার ভ্যান চালান তার স্বামী। বলেন, মানুষটি আজ ১ মাস ৩ দিন ধরে এভাবে ছটফট করছে। এর আগে আইসিইউতে ছিল। রোববার তাকে ওয়ার্ডে দিয়েছে। রশিদের পাশেই যন্ত্রণায় নীরবে চোখের পানি ফেলছিলেন ষাটোর্ধ্ব আরও এক দগ্ধ রোগী। শুধু তিনিই নন। নারী-পুরুষ-শিশু মিলে এধরনের আরও ৩৮ রোগী ওয়ার্ডটিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.