জাতীয় ভাষা জাতির ধমনির রক্ত by সৈয়দ আবুল মকসুদ

কোনো জাতিরাষ্ট্রে জাতীয় ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দিলে তার স্বাধীন সত্তা পূর্ণতা পায় না। একটি দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন মাতৃভাষা থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয় ভাষা একটি। রাষ্ট্রের সরকারি-বেসরকারি যাবতীয় কার্যক্রম জাতীয় ভাষাতেই হয়ে থাকে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাতৃভাষায় নয়।
আমার পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে গিয়েছিলেন। ওসব দেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভিসন্দর্ভ রচনা করে ডক্টরেটও করেছেন। ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হলে ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট ভাষায়ই করতে হয়। সেখানে গিয়ে প্রথমেই সে দেশের জাতীয় ভাষা শিখতে হয়। সে জন্য বছর খানেক চলে যায় ভাষা শিখতেই। কোনো কোনো দেশে বিদেশিদের ইংরেজিতে অভিসন্দর্ভ লিখতে অনুমতি দেওয়া হলেও সে দেশের সরকারি বা জাতীয় ভাষা বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হয়। এবং অভিসন্দর্ভ ইংরেজিতে লিখলেও তার একটি ৪০-৫০ পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ ওই দেশের জাতীয় ভাষায় লেখা বাধ্যতামূলক।
সত্তরের দশকে ঢাকা জেলার একজন বিস্মৃত মনীষীকে নিয়ে আমি কিঞ্চিৎ গবেষণা করেছিলাম। তাঁর নাম নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর পরগণার পশ্চিমপাড়ার অধিবাসী। সে এলাকা নদীতে চলে গেছে। এক রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান ছিলেন তাঁরা তিন ভাই: নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও শীতলাকান্ত চট্টোপাধ্যায়। অমন গুণী তিন সহোদর সমগ্র বাংলায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছাড়া আর কোনো পরিবারে বিশেষ ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের মাস খানেক আগে নবকান্ত প্রবেশিকা পাস করেন। এখন যা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, একদিন তা ছিল জগন্নাথ স্কুল। সেই স্কুলে তিনি ছিলেন শিক্ষক। এখন যা ইডেন কলেজ, একদিন তা ছিল ইডেন স্কুল, সেই স্কুল প্রতিষ্ঠায় নবকান্তের ভূমিকা খুব বড়। তিনি ছিলেন ইডেন স্কুলের প্রথম সেক্রেটারি। বাল্যবিবাহ বন্ধ, স্ত্রীশিক্ষা, শিক্ষা বিস্তার প্রভৃতি সমাজসংস্কারে তাঁর ভূমিকা সেকালের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করত। ঢাকা তথা পূর্ব বাংলার ইংরেজি-বাংলা সাংবাদিকতার তিনি পথিকৃতের একজন। তাঁর তিন খণ্ডের সঙ্গীত মুক্তাবলীর দুটি খণ্ড আমাদের সংগ্রহে ছিল। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন শুরুর সামান্য আগে তিনি গত হন।
তাঁদের সবচেয়ে ছোট ভাই শীতলাকান্ত ছিলেন উনিশ শতকের উপমহাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিকদের একজন। তিনি ছিলেন অবিচল জাতীয়তাবাদী, পেশায় আইনজীবী। উনিশ শতকের সত্তরের দশকে তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন ইংরেজি সাপ্তাহিক ইস্ট এবং পরে লাহোর থেকে ট্রিবিউন। ট্রিবিউন-এ সরকারের দমন-পীড়ন ও পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী লেখা প্রকাশিত হতো। ঢাকা, ময়মনসিংহ, আসামের বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনের তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব।
নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের পাঁচ বছর আগে। তিনি ছিলেন বিরাট পণ্ডিত। ২০ বছর বয়সে জার্মানি যান। তিনি জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিশ নিৎসের সমসাময়িক। লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শনশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তাঁর পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে আরও ছিল ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস প্রভৃতি। পরে জার্মানি থেকে যান সুইজারল্যান্ডে। সেখানে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি করেন। নিশিকান্তের অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘যাত্রা বা বাংলার লোকনাটক’, থিসিসের ইংরেজি শিরোনাম ছিল ‘দ্য যাত্রাস অর দ্য পপুলার ড্রামাস অব বেঙ্গল’। তবে থিসিসটি তাঁকে লিখতে হয়েছিল জার্মান ভাষায়।
নিশিকান্ত ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। তারপর অধ্যাপনা করতে যান রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই প্রথম ভারতীয় অধ্যাপক। শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপ থেকে ফিরে হায়দরাবাদ ও মহীশূর কলেজে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
নিশিকান্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাতিজা সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর। জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর অমূল্য রচনাবলি রয়েছে। যেকোনো কারণেই হোক শেষ জীবনে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তাঁর শেষ দিনগুলো খুবই করুণ। অবহেলা পেয়ে ১৯১০ সালে মারা যান এবং হারিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে।
অকালপ্রয়াত সাংবাদিক আহমেদ ফারুক হাসান ছিল আমার অতি স্নেহভাজন এবং পরিবারের সদস্যের মতো। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েই আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার আপনজন হয়ে যায়। প্রায়ই আমার বাসায় আসত এবং মাঝেমধ্যে থাকতও। নিশিকান্ত ভাইদের সম্পর্কে আমার আগ্রহের কথা শুনে ওরও প্রবল আগ্রহ দেখা দেয়। নিশিকান্তকে নিয়ে গবেষণা করবে বলে জানায়। ওর তাগিদে ভারত থেকে আমি নিশিকান্তের বেশ কিছু রচনার ফটোকপি ওকে সংগ্রহ করে দিই। বেঁচে থাকলে তাঁকে নিয়ে ফারুক ভালো কাজ করতে পারত। নিশিকান্তের লম্বা কাহিনির বয়ান করলাম এ জন্য যে তাঁর জীবন থেকে জানতে পারি তিনি যখন জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, তখন জার্মান ভাষাতেই করেন, ইংরেজিতে নয়। যখন রাশিয়ায় অধ্যাপনা করতেন, তখন রুশ ভাষাতেই করতেন।
১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্টাডি লিভ নিয়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি চর্যাপদ বা বাংলা মরমি গান নিয়ে গবেষণা করেন, তবে তা ইংরেজি ভাষায় নয়, ফরাসি ভাষায়। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল Les Chants Mystique. একই বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন, সেটিও করেন ফরাসি ভাষায়, শিরোনাম—Les sons du Bengalie. আমার অগ্রজ বন্ধু মাহমুদ শাহ কোরেশীসহ বাংলাদেশ ও ভারতের যাঁরা ফরাসি দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের সব গবেষণাপত্রই ফরাসি ভাষায়।
শুধু সংবিধানে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি থাকলেই কোনো ভাষার উন্নতি হয় না। দুই দশক যাবৎ যে বিপুলসংখ্যক ভাষাসৈনিকের নাম আমরা সারা বছর শুনছি, তাঁদের কোনো আন্দোলন ছাড়াই পাকিস্তান সরকার উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছিল ষাটের দশকে। সে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তখন বাংলা পাঠ্যবই ছিল না। সহায়ক বই ও বাংলা পরিভাষাকোষ প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলা একাডেমিকে।
মুহম্মদ এনামুল হক ছিলেন বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক। বিভিন্ন বিষয়ের ‘পারিভাষিক শব্দকোষ’ তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয় ১৯৬৪-র দিকে। মধ্য ’৬০-এ কিছু কিছু পুস্তিকা বেরিয়েছিল। যেমন আর্থনীতিক পরিভাষাকোষ। ড. হকের ভাষায়, ‘চারিজন অর্থনীতিবিদকে লইয়া একটি “আর্থনীতিক পরিভাষা-উপসংঘ” গঠিত হয়। প্রায় বৎসরাধিক কাল যাবৎ একটানা পরিশ্রমের পর উপসংঘটি ৪,১৫০ শব্দ সমন্বিত একটি পরিভাষাকোষ প্রস্তুত করিয়া বিগত ২৩-২-৬৫ তারিখে প্রকাশের জন্য বোর্ডে দাখিল করেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ড. নূরুল ইসলাম ছিলেন উপকমিটির সভাপতি। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ড. মির্জা শাহজাহান, অধ্যক্ষ সফীকুর রহমান প্রমুখ। বাংলা একাডেমি দর্শনকোষও করেছিল।
মাস্টার্স পর্যন্ত বিজ্ঞানশিক্ষা যাতে বাংলা ভাষায় হয়, সে জন্য প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা সব সময় চেষ্টা চালিয়েছেন। রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞানের ইংরেজি শব্দের পরিভাষা তৈরিতে তিনি অনেক কাজও করেছেন। তাঁর একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমি কিছুদিন তাঁর সঙ্গে ছিলাম। আমি জানি, তাঁর স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানের সব বিষয়ে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা।
পাকিস্তানি আমলে বাঙালি চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অনেকেই ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী। পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা সবাই ছিলেন বাংলাপ্রেমী। কবি ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিকের মাধ্যমে ডা. এস আই এম জি মান্নান, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. নুরুল ইসলামসহ তাঁদের পুরো গ্রুপের সঙ্গে আমারও ঘনিষ্ঠতা জন্মে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা বের হয়েছিল। রফিক ভাইয়ের সঙ্গে আমি তাতে যুক্ত ছিলাম। ওই কাজ স্বাধীনতার পরে ভালোমতো সম্পন্ন হলে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের মতো বাঙালি শিক্ষার্থীরাও জাতীয় ভাষা বাংলাতেই এমবিবিএস পড়তেন।
প্রতিষ্ঠার পর বাংলা একাডেমির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির মধ্যে ছিল: ‘শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার সহজসাধ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পুস্তকাদি প্রণয়ন।’ স্বাধীনতার আগে ইচ্ছা থাকলেও ওই কাজটি তারা করতে পারেনি। আশির দশক থেকে উচ্চশিক্ষার সহায়ক বাংলা বইপত্র একাডেমি প্রকাশ করছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বই বেরিয়েছে। বন্য প্রাণী বিষয়ে আমার বন্ধু ড. রেজা খান বড় বই লিখেছেন। বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলা লেখকেরা আনুকূল্য পান না। কীটতত্ত্ব ও প্রাণিবিজ্ঞান বিষয়ে ড. রেজাউর রহমান ও ড. মোশারফ হুসেইনের মানসম্মত বইগুলো বাংলা একাডেমি বহু আগে বের করেছিল। সেগুলোর ফটোকপি এখন বিক্রি হয় নীলক্ষেত মার্কেটে, কিন্তু একাডেমি পুনর্মুদ্রণ করেনি। প্রাণী বিজ্ঞানী রেজাউর রহমান এখন ছোটগল্পকার ও কথাশিল্পী হিসেবেই বেশি খ্যাত।
জাতীয় ভাষা জাতির ধমনির রক্ত। উচ্চশিক্ষা ও অফিস-আদালতে জাতীয় ভাষার সুষ্ঠু ব্যবহার ছাড়া জাতীয় উন্নতি সম্ভব নয়। আমাদের জাতীয় ভাষা বাংলা জাতীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করা আজও সম্ভব হয়নি। সেই ব্যর্থতার দায় শুধু সরকারের নয়, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজকেও বহন করতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.