মমতা ব্যানার্জির সফর; অতঃপর... by নূরে আলম সিদ্দিকী

মনমোহন সিং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে পূর্ণ ঘোষণা দিয়ে তিস্তা ব্যারেজ এবং সীমান্ত চুক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন। অতি বিনম্র স্বভাবের আপসহীন মননশীলতার এই রাজনীতিবিদকে স্টেটসম্যান বলাই বাঞ্ছনীয়। তার দূরদর্শিতা বিবেচনায় এনে বিষয়টি নিয়ে সকল মুখ্য রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার সুদীর্ঘ মতবিনিময় হয়- আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক। এর পরেই সম্ভবত তিনি ঘোষণাটি দিয়েছিলেন এবং সেটি তার চরিত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখনও মমতা ব্যানার্জি। তারও সঙ্গে আসার কথা ছিল। বিজেপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না থাকলেও বিজেপি’র প্রথম সারির নেতা সুষমা স্বরাজ ও মমতা ব্যানার্জি মনমোহন সিংয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে সোচ্চার ছিলেন। পানিসঙ্কটের সমাধানটির অন্তর্নিহিত অনেক তত্ত্ব ও তথ্য রয়েছে এবং কিছু জটিলতাও রয়েছে। আজকে আমি সে আলোচনায় আসতে চাই না।
রক্তস্নাত সাফল্যে প্রদীপ্ত সূর্যালোকে উদ্ভাসিত একুশে ফেব্রুয়ারি। সেটা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। সেই মহান গৌরবোজ্জ্বল দিবসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি এ আমন্ত্রণটিকে শুধু নিষ্কলুষ ঐকান্তিকতায় গ্রহণই করেননি, তাঁর আকাশছোঁয়া আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এবং নির্দ্বিধায় বারবার ঘোষণা করেছেন যে, তিস্তা ব্যারেজের সমাধানের বিষয়টি এখন তাঁর নিজের। প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে উদ্দেশ্য করে দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন- বাংলাদেশ-ভারতের অমীমাংসিত সমস্যা- বিশেষ করে তিস্তা ব্যারেজের বিষয়ে সকল দায়ভার তার। নিজ দায়িত্বে তিনি এ সমস্যার সমাধান করবেন। যথারীতি বাংলাদেশে তাঁর শুভাগমন, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন আমরা বিমোহিত চিত্তে, সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছি। মমতা ব্যানার্জি কতটুকু অনুধাবন করেন জানি না, কিন্তু তাঁর কিছু কিছু উচ্চারণে উচ্ছ্বাস এতটাই প্রবল থাকে যে, তিনি হয়তো ভুলে যান- তিনি ভারতের ২৭টি প্রদেশের মধ্যে একটি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী- কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী নন। তাঁর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তিনি অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেন। তবে এটা সত্য, অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা সঙ্গত হবে না এ কারণে যে- সীমান্ত, ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি এমনকি তিস্তার পানিবণ্টন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের একটি নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। যদিও তিনি বিজেপি’র মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তাদের মতানৈক্যটা প্রকাশ্য এবং ক্রমেই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। খুনোখুনি, পিটাপিটি, তীর্যক বাক্যবিনিময় এটা তো নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশের ন্যায্য দাবির উপর তিনি যদি থাকেন বা থাকতে পারেন তবে সারা ভারতবর্ষে তো বটেই, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও একটা মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন। যদিও রাজনৈতিকভাবে তাকে আমি প্রত্যয়দৃঢ় ও সুস্থির মনে করি না। সুদিনে, সঙ্কটে বহুবার তাকে রাজনৈতিক মত ও পথের পরিবর্তন করতে দেখেছি। তবুও এ বিষয়টির ব্যাপারে এমনকি এই সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশের- বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সময় তাকে কিছুটা ম্রিয়মাণ, নিষ্প্রভ এবং অনেকটা আমতা-আমতা করতে দেখা গেছে। তাঁর সফরসঙ্গীদের মধ্যেও রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ বা পানি বিশেষজ্ঞের চেয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সমাহার বেশি।
সমস্যা সমাধানে অনেক জটিলতা আছে- এটা সত্য, তবুও শেখ হাসিনা মমতা ব্যানার্জিকে কৌতুক করে বলেছেন- ‘পানি আসলে ইলিশও যাবে’। এটাকে রসিকতা হিসেবে না নিয়ে অনেকে গুরুত্বসহকারে নিলেও নিতে পারেন। সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি অবসানে তাঁর বক্তব্য জোরালো ছিল না। তবে একটি ব্যাপারে বেশ আন্তরিক মনে হয়েছে। এটিএন বাংলার মতো বাংলাদেশের সকল সমৃদ্ধ চ্যানেলগুলো পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রচারের ব্যাপারে একটা নিশ্চিত আশ্বাস পাওয়া গেছে। এই অর্জনকেও অবহেলা করার উপায় নেই যদি সেটাকে তিনি বাস্তবায়িত করেন।
আমাদের টিভি অনুষ্ঠানগুলো পশ্চিমবঙ্গে প্রচারিত হলে ওপার বাংলার মানুষেরা অনুভব করতে পারবেন- বুকের তাজা রক্তে শুধু আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনেই সক্ষম হইনি, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনেরও সৌভাগ্য অর্জন করেছি। অধিকার আদায়ের এই ঐতিহাসিক সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে বাঙালির মননশীলতা, অকুতোভয় প্রতীতি-প্রত্যয় সৃষ্টির মাধ্যমে একেকটি আন্দোলনের স্তর ও বিন্যাস অতিক্রম করে আমরা পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছি। এখানে ভারতের অবদান নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য, তবুও বাংলাদেশের একটি বিরাট অংশ আমাদের কিছু কিছু সমস্যা জিইয়ে রাখার কারণে বিক্ষুব্ধ ও বীতশ্রদ্ধই নয়, স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও ভারতের প্রতি একটা সন্দেহের মেঘ ভারতবিদ্বেষী নন এমন অনেকের হৃদয়ের ক্যানভাসে জমাট বাঁধে। এমন অনেকেই এখন বলাবলি করছেন বিগত দিনে মমতা ব্যানার্জি এবং সুষমা স্বরাজের জন্যই মনমোহন সিং সমস্যাটির সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। এখন মমতার সঙ্গে বিজেপি’র সম্পর্কের যে তিক্ততা এবং তাদের দু’টি দলের মধ্যে যে সংঘাত ও বিরোধিতা প্রতীয়মান হচ্ছে তাতে মমতার সমর্থনের কারণে দামোদর নরেন্দ্র মোদির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি না হয়ে যায়। তবে অনেক উস্কানি সত্ত্বেও বাংলাদেশ পানিবণ্টনের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এর কারণ কোন আজ্ঞাবহ দুর্বলতা নয়, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের প্রতি আস্থারই নয়; এটা মরুভূমির সূর্যোদয়ের মতো নিষ্কলুষ সত্য যে, কোন কোন নেতৃত্বের হীনমন্যতা যত তীক্ষ্ণই হোক না কেন- ভারতে জনতার শক্তি অপ্রতিরোধ্য। সেখানকার সর্বস্তরেই গণতন্ত্র একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। আমাদের দাবির পক্ষে সেই জনমতকে যদি আমরা উজ্জীবিত করতে পারি, তবে মুক্তযুদ্ধকালীন সময়ের মতোই ভারতের জাগ্রত জনতা নরেন্দ্র মোদিকে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে বাধ্য করবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা, এমনকি বিশ্বাসের আঙ্গিকও বলা যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.