সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য -১৫৮ by ড. একেএম শাহনাওয়াজ

মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি গঠন : নওয়াব আবদুল লতিফ ১৮৬৩ সালে ‘মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি’ নামে মুসলমানদের একটি সাহিত্য সমিতি গঠন করেন। এ সমিতি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে উৎসাহ প্রদান করা। সমিতির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আবদুল লতিফ নিজে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তা অনেকটা এ রকম- ‘মুসলমানদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত করানো এবং সামাজিক আচার-আচরণে তাদের শিক্ষিত হিন্দু ও ইংরেজদের সমকক্ষ করে গড়ে তোলা।’ এ উদ্দেশ্যে সভায় নিয়মিত আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এখানে বিজ্ঞান, কলা ও সমকালীন নানা সমস্যা নিয়ে মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা ছিল। এভাবে মুসলমানদের সঙ্গে ইংরেজ শাসকদের মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরিরও চেষ্টা করেন তিনি। এই সমিতির বিভিন্ন কার্যক্রমে বিভিন্ন ধর্মের প্রথিতযশা গুণী ব্যক্তিরাও অংশগ্রহণ করতেন। আবদুল লতিফ ‘মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির’ মাধ্যমে মুসলমানদের মৌলিক সমস্যার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নওয়াব আবদুল লতিফ একজন উদারপন্থী ব্যক্তি ছিলেন। নিজ ধর্মের পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নতির জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল না। শিক্ষার প্রসারতা ঘটিয়ে তিনি শুধু মুসলমানদের অগ্রগতির পথই দেখাননি, বরং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি ও ইংরেজ শাসকদের সুদৃষ্টি লাভের চেষ্টা করেছেন। তার প্রচেষ্টায় মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজ বিদ্বেষ অনেকটা কমে আসে। বাংলার গণমানুষের জন্য তিনি যেসব সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারমূলক কাজ করেন সেজন্য তাকে বাংলার ‘সৈয়দ আহমদ’ বলা হয়। বাংলার এই মহান মনীষী ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই ইন্তেকাল করেন।
নওয়াব আবদুল লতিফ নিজ মেধার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ১৮৭৭ সালে লর্ড লিটন তাকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করেন। এছাড়াও তাকে ‘রানীর মেডেল’ (Empress Medal) দেয়া হয়। লর্ড লিটন ১৮৮০ সালে আবদুল লতিফকে সর্বোচ্চ খেতাব ‘নওয়াব’ উপাধীতে ভূষিত করেন। লর্ড ডাফরিন এই খেতাবকে আরও উন্নীত করে ‘নওয়াব বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) : বলা হয় সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন হযরত মোহাম্মদের (সা.) পরবর্তী অষ্টম ইমামের বংশধর। তার পূর্বপুরুষ পারস্যের সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আব্বাসের অধীনে চাকরি করতেন। নাদির শাহের আক্রমণের সময় তারা ভারত আসেন। তাদের এক পূর্বপুরুষ তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। আমীর আলীর পিতা সাদত আলী খান বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। ১৮৪৯ সালের ৬ এপ্রিল উড়িষ্যার কটকে আমীর আলী জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এরপর পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং চিনসুরাতে পাকাপাকিভাবে বসতি স্থাপন করেন।
মুসলিম সম্প্রদায়ের জাগরণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন সৈয়দ আমীর আলী। রাজনীতিক, আইনবিদ ও ইসলামের ইতিহাস রচয়িতা হিসেবে উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছিলেন সৈয়দ আমীর আলী। তিনি ১৮৬৯ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত লন্ডনে আইনশাস্ত্রের ওপর পড়ালেখা করেন। ১৮৭৩ সালে দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পরের বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসেবে মনোনীত হন। একই সঙ্গে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ইসলামী আইনের বিভাগে লেকচারার পদে নিয়োগ পান। ১৮৭৮ সালে আমীর আলী বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৮৮৩ সালে তিনি গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন। এর আগে ১৮৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ব্যক্তিগত যোগ্যতা তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যায়। আমীর আলী ১৮৯০ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভ করেন।

No comments

Powered by Blogger.