নীল জলে ভাসমান ছেঁড়াদিয়া by আব্দুল কুদ্দুস

নীল সমুদ্রের মাঝখানে ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ
নির্জন সাদা বালিয়াড়ির ওপর আছড়ে পড়ছে নীল ঢেউ। আকাশে চক্কর দিচ্ছে গাঙচিলের ঝাঁক আর স্বচ্ছ অগভীর জলে হরেক রকমের প্রবাল ও শৈবালের মেলা। ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে পা রাখতেই মন আচ্ছন্ন হবে এর নৈসর্গিক সৌন্দর্যে। টেকনাফ থেকে নৌপথে সেন্ট মার্টিনের দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিলোমিটার। আবার সেন্ট মার্টিন থেকে ছেঁড়াদিয়া ১০ কিলোমিটার দূরে। ১০ জানুয়ারি সেন্ট মার্টিন থেকে ছেঁড়াদিয়ায় পৌঁছাতেই স্বাগত জানাল গাঙচিলের ঝাঁক। সাগরের নীল জলে চলছিল পাখিদের মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। যন্ত্রচালিত নৌকা ও স্পিডবোটে সেন্ট মার্টিন থেকে আসা বেশ কয়েকজন পর্যটকেরও দেখা মিলল। ছেঁড়াদিয়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ তাঁরাও। প্রবাল, শৈবাল আর নীল ঢেউয়ের দ্বীপটি এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। তবে পর্যটকদের ফেলা আবর্জনার কারণে দূষিত হচ্ছে এই দ্বীপ। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
যেভাবে যেতে হয়: বাংলাদেশের মানচিত্রের সর্বদক্ষিণের শেষ বিন্দু এই দ্বীপ। এক বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি ছেঁড়াদ্বীপ নামেও পরিচিত। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই দ্বীপে এখনো লোকবসতি গড়ে ওঠেনি। জোয়ারের সময় সেন্ট মার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ছেঁড়াদিয়া। তবে ভাটার সময় কয়েক কিলোমিটার পাথুরে সৈকত পাড়ি দিয়েও সেন্ট মার্টিন থেকে ছেঁড়াদিয়ায় আসা যায়। জোয়ারের সময় যন্ত্রচালিত নৌকা কিংবা স্পিডবোটে আসতে হয় এই দ্বীপে।
জীববৈচিত্র্য: কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের ও মৎস অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী। দ্বীপটির কোমরসমান স্বচ্ছ পানিতে নামলে পাথরের স্তূপের ওপর নানা প্রজাতির প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক ও অসংখ্য প্রজাতির মাছ দেখা যায়। ভাটার সময় দ্বীপের চারদিকে বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল দৃশ্যমান হয়। ভ্রমণে আসা অনেক পর্যটক এসব আহরণ করেন। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ আইনে এই দ্বীপের প্রবাল ও শামুক-ঝিনুক আহরণ নিষিদ্ধ করা আছে। শহর থেকে সব সময় আসা-যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সৌন্দর্য হারাচ্ছে ছেঁড়াদিয়া: শীত মৌসুমে ছোট্ট এই দ্বীপে পর্যটকের ভিড় বাড়ে। এ কারণে দ্বীপে অবৈধভাবে তৈরি হচ্ছে অস্থায়ী দোকান ও রেস্তোরাঁ। বিক্রি হচ্ছে ডাব, কাঁকড়া, লবস্টার ও মাছ ভাজা। পর্যটকেরা চড়া দামে এসব কিনে খাচ্ছেন।
বেশির ভাগ পর্যটক হাঁটুসমান নীল জলের স্বচ্ছ পানিতে নেমে প্রবাল ও শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া পর্যটকদের ফেলা পলিথিন, প্লাটিকের বোতল ও ডাবের খোসা দ্বীপের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এসব নিয়ন্ত্রণে সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের কেউ নেই।
দ্বীপের অস্থায়ী রেস্তোরাঁর মালিক সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, ডিসেম্বর থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটক আসা শুরু হয়। এই সময় অনেক পর্যটক ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে বেড়াতে আসেন। তাঁদের চাহিদার কথা ভেবে এই দোকান খুলেছি। সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। মার্চ মাস পর্যন্ত এই ব্যবসা চলে। এরপর পর্যটক আসা বন্ধ হলে দোকানও সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে।
ছেঁড়াদিয়া ভ্রমণে আসা কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, মানুষের অত্যাচারে দ্বীপটি সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। একটি নীতিমালা তৈরি করে ছেঁড়াদিয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
পরিত্যক্ত মেরিন পার্ক: সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়াদিয়ার প্রকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৭ সালে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মেরিন পার্ক প্রতিষ্ঠা করলেও বর্তামান প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পের স্থাপনাও পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, মেরিন পার্ক স্থাপন করা হলেও এর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় সেখানে এখন কেউ নেই। গভীর সমুদ্রের মধ্যে দ্বীপের অবস্থান বলে কক্সবাজার শহর থেকে সব সময় আসা-যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.