স্থবির আমদানি-রপ্তানি- স্থলবন্দরে আটকা শত শত ট্রাক

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধে ভেঙে পড়েছে অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা। এর প্রভাব পড়েছে দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দরে। নিরাপত্তার অভাবে সীমান্তের ওপারে থাকা পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে না। পণ্য খালাসের অপেক্ষায় আটকে আছে শ’ শ’ ট্রাক। একই কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা সীমান্তের বন্দরগুলোতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তার আশ্বাস সত্ত্বেও পরিবহন মালিক ও ব্যবসায়ীরা বন্দরমুখী হচ্ছেন না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে গাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন কতিপয় পরিবহন ব্যবসায়ী। ফলে যারা পুলিশ ও বিজিবি পাহারায় পণ্য পরিবহন করছেন, তারা ভাড়া মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। যার প্রভাব পড়েছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে। স্থবির হয়ে পড়েছে বন্দরগুলোর কার্যক্রম। পচন ধরেছে খালাসের অপেক্ষায় থাকা পণ্য। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর কয়েকটি বন্দরে পুলিশ ও বিজিবি পাহারায় আমদানি-রপ্তানি শুরু হয়েছে।
চাঁপাই নবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধে ১১ দিন ধরে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এতে প্রায় ২২ কোটি টাকা হয়েছে বলে জানিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পণ্যবাহী ট্রাকে একের পর এক আগুন দেয়ায় বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রেখেছেন। এদিকে পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ইয়ার্ডে আটকা পড়েছে দুই শতাধিক পণ্যবাহী ভারতীয় ট্রাক। বাংলাদেশী ট্রাকের অভাবে ভারতীয় এসব ট্রাক থেকে পণ্য খালাস করতে না পারায় আমদানিকৃত কাঁচা পণ্য পিয়াজ, আদাসহ বিভিন্ন ফলে পচন দেখা দিয়েছে। সোনামসজিদ সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব সোহেল আহমেদ পলাশ জানান, গত ৭ই জানুয়ারি থেকে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় কাঁচা পণ্যবাহী বেশ কিছু ট্রাক গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আবার গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে বেশ কয়েকটি ট্রাকে আগুন দেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশী ট্রাকের অভাবে ভারতীয় ট্রাক থেকে পণ্য খালাস করতে না পারায় পানামা ইয়ার্ডে দুই শতাধিক ভারতীয় ট্রাক আটকা পড়েছে। ভারতের ট্রাকচালক মাজহারুল হোসেন জানান, কলকাতা থেকে আমলকি নিয়ে ১০ দিন আগে তিনি সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আসেন। কিন্তু বাংলাদেশী ট্রাকের অভাবে তার ট্রাক থেকে পণ্য খালাস করতে না পারায় তিনি আটকা পড়েছেন। অন্ধ্রপ্রদেশের ট্রাকচালক অমর দাস জানান, তিনিও ৯ দিন আগে উত্তরপ্রদেশের ফতেপুর থেকে পিয়াজ নিয়ে এ বন্দরে আসেন। কিন্তু পণ্য এখনও খালাস করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও জানান, তিনি যা টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছিলেন তাও প্রায় ফুরিয়ে যেতে বসেছে। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের আমদানিকারক মনিরুল ইসলাম বলেন, এ বন্দরে পচনশীল পণ্য আটকা পড়ায় ইতিমধ্যে কিছু ফল, পিয়াজ ও আদায় পচন ধরতে শুরু করেছে। সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার নুরুল বাশির জানান, বর্তমানে বন্দরে দুই শতাধিক ভারতীয় ট্রাক আটকা পড়েছে। বাংলাদেশী ট্রাকের অভাবে ওই সব ট্রাক থেকে পণ্য খালাস করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পণ্যজটের কারণে বন্দরে কোন ভারতীয় ট্রাক ঢুকছে না। তিনি বলেন, প্রতিদিন এ বন্দর থেকে সরকার কমপক্ষে ২ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে থাকে। সে হিসাবে গত ১১ দিনে ২২ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জ চেম্বার সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ জানান, বন্দরে পণ্য খালাস করতে না পারায় আমদানিকারকরা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, অবরোধের কারণে আখাউড়া স্থলবন্দরে রপ্তানি কার্যক্রম অর্ধেক কমে গেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রায় ২০০ ট্রাক এ বন্দর দিয়ে যাওয়া-আসা করতো। প্রায় এক কোটি টাকার ওপরে আমদানি-রপ্তানি হতো। অবরোধের কারণে এখন প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক যাতায়াত করছে। কমে এসেছে রপ্তানির পরিমাণ। এখন প্রতিদিন ৫০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। আখাউড়া বন্দর দিয়ে মূলত পাথর, সিমেন্ট, শুঁটকি, মাছ, প্লাস্টিকদ্রব্য, পাটজাতদ্রব্য রপ্তানি। এসব দ্রব্য আসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর থেকে। অবরোধের কারণে এসব এলাকা থেকে ট্রাক নিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ত্রিপুরার আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সেক্রেটারি হাবুল বিশ্বাস মোবাইল ফোনে জানান, বাংলাদেশে অবরোধের কারণে গাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী সেখান থেকে মাল কিনতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বিশেষ করে ছোট ছোট ব্যবসায়ী এ বাড়তি ভাড়া বহন করতে পারছেন না। সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত একটি ট্রাকের ভাড়া আগে ছিল ১৪ হাজার। এখন সেই ভাড়া প্রায় ২০ হাজার পার হয়ে গেছে। আখাউড়া বন্দরের রপ্তানিকারক সমিতির সেক্রেটারি ও প্রিয়াংকা এন্টারপ্রাইজের সেক্রেটারি হাজী তাজুল ইসলাম বলেন, আখাউড়ার বন্দরে মারাত্মকভাবে অবরোধের প্রভাব পড়েছে। রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ট্রাকমালিকরা ভয়ে গাড়ি বের করছেন না। ফলে গাড়িভাড়া বেড়ে গেছে। তবে বন্দরে রপ্তানি কার্যক্রম কমে যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি স্বীকার করেননি আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, রপ্তানি কার্যক্রম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা মাল নিতে আসছেন না।
হাকিমপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, টানা হরতাল, অবরোধ ও পণ্য পরিবহনের অভাবে স্থবিরতা বিরাজ করছে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে। অতিরিক্ত গাড়িভাড়ার কারণে পুলিশ ও বিজিবির পাহারায় পণ্য পরিবহনের আগ্রহ কম ব্যবসায়ীদের। পণ্য পরিবহন না হওয়ার কারণে বন্দরের অভ্যন্তরে ও ব্যবসায়ীদের পোডাউনে জট লেগে আছে। পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে বন্দর থেকে পণ্যও ছাড় হচ্ছে কম। প্রতিদিন বন্দরে কমবেশি এক থেকে দেড় শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক বন্দর অভ্যন্তরে থাকছে পণ্য খালাসের অপেক্ষায়। পুলিশ ও বিজিবি নিরাপত্তা দিলেও আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের তেমন কোন উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত গাড়িভাড়া দিয়ে ও অজানা আতঙ্ক নিয়ে তারা পণ্য সরবরাহ করতে চাচ্ছেন না। এদিকে পুলিশ ও বিজিবির পাহারায় হিলি স্থলবন্দর থেকে প্রতিদিন পিয়াজ, চাল ও কয়লার মতো ৩০ থেকে ৪০ ট্রাক পণ্য বগুড়া মোকামতলা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। হিলি স্থলবন্দরে ব্যবসায়ী আরকে ট্রেডিংয়ের মালিক রাজীব কুমার দত্ত জানান, হরতাল ও অবরোধের আগে তিনি বন্দর ও নিজস্ব গোডাউন থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ ট্রাক চাল বিক্রি করে থাকেন, কিন্তু বর্তমানে অবরোধের কারণে তার পাইকারের সংখ্যা কমেছে, যে দু-চারজন ব্যবসায়ী তার কাছে থেকে চাল কিনছেন তারা পরিবহনের ঝুঁকি নিতে চাইছে না, ফলে তাকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বিক্রির অভাবে প্রচুর পরিমাণে চাল পড়ে আছে তার গোডাউনে ও বন্দরে। ফলে তাকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। তার মতো একই অবস্থা বন্দরের ছোট-বড় শতাধিক আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের। পানামা হিলি পোটের অপারেশন ম্যানেজার এস এম হায়দার আলী জানান, পণ্য ডেলিভারি কম হওয়ার কারণে, রাতে ভারতীয় গাড়ির অবস্থান বাড়ছে। গাড়িভাড়া বেশি হওয়ার কারণে অনেকে বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করছেন না, ফলে পণ্যজট লেগে আছে। হিলি কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মহিবুর রহমান জানান, হিলিবন্দর দিয়ে কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। তবে হরতাল ও অবরোধের কারণে ব্যবসায়ীরা কিছুটা কম পণ্য খালাস করছেন বন্দর দিয়ে।
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গতকাল থেকে এ বন্দর দিয়ে আগের মতো বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে শুরু হয়েছে মালামাল আমদানি-রপ্তানি। অবরোধ ও হরতালের কারণে ভারত ও নেপাল থেকে আনা পাথর, কয়লা, চাল, গম, ডালসহ অন্যান্য পণ্য বন্দরের ওয়্যার হাউজে রাখা হয়। এসব পণ্য ইতিমধ্যে বিজিবি ও পুলিশ পাহারায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো শুরু হয়েছে। গত কয়েক দিনে ১ হাজার ১৪০টি পণ্যবাহী ট্রাক ও ৫৭টি জ্বালানি বহনকারী লরি বিজিবি’র পাহারায় নিরাপদে পঞ্চগড় জেলায় চলাচল করেছে।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানিকৃত সব ধরনের পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করতে বিজিবি সদস্যরা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। ফলে বন্দরের অচলাবস্থা কাটবে বলে ব্যবসায়ীরা আশা করছেন।
পাটগ্রাম (লালমনিরহাট) প্রতিনিধি জানান, প্রশাসনের কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও স্বাভাবিক হচ্ছে না বুড়িমারী স্থলবন্দরের কার্যক্রম। স্বাভাবিক অবস্থায় শতাধিক ট্রাক এ বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেয়া করে। বর্তমানে প্রতিদিন ৫০-৬০টি ট্রাক বন্দর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। কয়লা রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। শুধু পচনশীল ফল হওয়ার কারণে লোকসানের আশঙ্কায় ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায়ীরা কমলা রপ্তানি করছেন।

No comments

Powered by Blogger.