সিজিএ কার্যালয়ে ১১ খাতে ঘুষ লেনদেন: টিআইবি

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের ১১ খাতে ঘুষ লেনদেন হয়। কেবল গাড়িচালকের একটি চাকরি পেতেই ঘুষ দিতে হয় ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। গতকাল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন দীপু রায়। এতে বলা হয়েছে, সিজিএ  কার্যালয়ে কাজ করানোর জন্য ৪ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। সিজিএ কার্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তদবিরে নিয়োগ দেয়া হয়। সম্প্রতি মধ্যমস্তরের একটি চাকরি দিতে ৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর তদবির আসার ঘটনাও ঘটছে। সিজিএর কার্যালয়ের এমন দুর্নীতি কমিয়ে আনতে ২০টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। বিভিন্ন অডিট, নিয়োগ, পদায়ন, বদলিসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সিজিএ কার্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে বলে টিআইবি মনে করছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবলের অভাব, হিসাবের প্রতিবেদন সময়মতো সম্পন্ন না করা, হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, নিয়োগ, পদোন্নতি ও অর্গানোগ্রামে সমস্যা, অডিট ও হিসাবের পৃথকীকরণ এবং সিএজি, সিজিএ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সমস্যা। মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং গ্রেডিংয়ে সমস্যা, জবাবদিহিতা ও তদারকিতে সমস্যা, অফিস স্থাপনা ও অন্যান্য লজিস্টিকের সাপোর্টের অভাব এবং প্রশিক্ষণের সমস্যাও চিহ্নিত করেছে টিআইবি। এসব সমস্যা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে, আর্থিক বিবরণে সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না, পরবর্তী বাজেটে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছু সুপারিশে সিজিএ অফিসকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে বলেছে টিআইবি। টিআইবি এসব দুর্নীতি মূলৎপাটনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করেছে।
নিরীক্ষা আইন না থাকা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি আইনসমূহ হাল নাগাদ না করা, মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীলতা, প্রয়োজনীয় জনবল, সুযোগ-সুবিধা ও জবাবদিহিতার অভাব, পরিবীক্ষণে সমস্যা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জবাব না দেয়া ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেয়া এবং পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি (পিএসি) কর্তৃক সব প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা না করাসহ মহাহিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে বিরাজমান সুশাসনের ঘাটতিজনিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ২০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিবেদনে সিএজি কার্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়, ২০১২ সাল থেকে নিরীক্ষা পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার সংযোজন ছাড়াও মিডিয়া এবং কমিউনিকেশন সেল গঠন এবং তথ্য অধিকার আইনের যথাযথ ব্যবহারের পদক্ষেপ গ্রহণ, নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও সিএজি কার্যালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশ এবং প্রথমবারের মতো প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহাহিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রশিক্ষণে বিশেষ সুযোগপ্রাপ্তিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক ও গাড়িচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষগ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্প অডিটের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র প্রতিবেদনে উঠে আসে। সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা দলের বিরুদ্ধে অডিট ইউনিটের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে, যার পরিমাণ কমপক্ষে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। ঘুষের পরিমাণ নির্ভর করে অডিট ইউনিটের বাজেটের পরিমাণের ওপর। এছাড়া তিন বছর পর বদলি করার নিয়ম থাকলেও ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে একই কার্যালয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা, অতিরিক্ত অর্থ আয়ের সুযোগ সম্পন্ন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠা যেমন- বন্ডেড ওয়ার হাউজ, ডিফেন্স অডিটের পূর্তসংক্রান্ত, এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন কলেজ ও স্কুল নিরীক্ষা করার জন্য ঘুষ আদায়ের অভিযোগ ইত্যাদি। প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, মহাহিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন সিএজি কর্তৃক বার্ষিক পরিকল্পনা না করা-মহাপরিচালক পর্যায়ে জবাবদিহিতা না থাকা, উপপরিচালক পর্যায়ে মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষা আপত্তি যাচাই-বাছাই না করা, কখনও কখনও অন্যায়ভাবে আপত্তি নিষ্পত্তি করা, মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষার কাজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক পরিবীক্ষণ না করা; মাঠপর্যায়ের নিরীক্ষাকালীন দুর্নীতি ধরা পড়লেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া; কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও তারিখ এবং গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি ঠিক নেই বলে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে হয়রানি করা।
অনুষ্ঠানে টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশের সর্বত্র ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সমস্যা বিরাজমান। আমাদের সংবিধান, শাসন কোন না কোনভাবে এক কেন্দ্রিকতার মধ্যে থাকছে। নিরীক্ষণের জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে তার সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ নেই। নিয়োগের ক্ষেত্রে তদবিরের সংস্কৃতি মহামারীর মতো হয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহি না করার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।
নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মহাহিসাব-নিরীক্ষকের আওতায় আর্থিক নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা থাকলেও প্রায়োগিক কাজে সেটি ব্যাহত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র দেখা যায়। ৬ বছর ধরে নিরীক্ষা আইন খসড়া হয়ে আছে কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত অনুমোদিত হচ্ছে না, যা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। মহাহিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ের সুশাসনের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য টিআইবি সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ২০ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অনিয়ম-দুর্নীতি রোধকল্পে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মাধ্যমে আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত নিরীক্ষা আইন প্রণয়ন, অর্গানোগ্রাম ও নিয়োগের বিধিমালার অনুমোদন দেয়া; সিএজিকে বাজেট, নিয়োগসহ সব বিষয়ে সাংবিধানিক স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিতকরণ; সিএজিসহ সব নিয়োগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; সিএজিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতির সমমর্যাদা দেয়াসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করা; নিরীক্ষার প্রতিবেদন সম্পন্ন করার ও জমা দেয়ার সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা; সিএজি কার্যালয়ের অভিযোগ সেল সম্পর্কে সরকারি কার্যালয়গুলোকে জানানোর জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো এবং অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। মধ্যমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে অন্যতম হলো- বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বড় আকারের দুর্নীতির তথ্যগুলো সিএজি পিএসিকে দেবে এবং পিএসি অভিযোগ অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য সুপারিশ করবে; ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা বৃদ্ধি করে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ করা এবং মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষা করার জন্য নিরীক্ষা দল গঠন করা; জরুরি কার্যক্রমের (ক্রাস প্রোগ্রাম) মাধ্যমে দীর্ঘদিনের পুরনো নিরীক্ষা আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরকে দুটি আলাদা অধিদপ্তরে ভাগ করা। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যয় ও হিসাবের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ শাখা খোলা; নিয়মানুবর্তী নিরীক্ষা থেকে পারফরম্যান্স নিরীক্ষার দিকে যাওয়ার কৌশল তৈরি করা এবং এজন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।

No comments

Powered by Blogger.