রাজাকার by শাহাবুদ্দীন নাগরী

পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা দখল করে নিলে মানুষশূন্য হয়ে যাওয়া মহকুমা শহরটা আবার মানুষজনে ভরে ওঠে। সরকারি অফিসগুলো চালু হয়, কিছু মিল-কারখানায় কাজ শুরু হয়, স্কুল-কলেজ খোলে, দোকানপাট চালু করে দোকানিরা। খুব অল্প গাড়ি চলাচল শুরু হয়, বেশিরভাগই আর্মির জিপ, ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স, কিছু রেডক্রসের গাড়ি। রিকশাও নামে রাস্তায়। শহরের লোকজনের এক কথা, মাস শেষে কারও হাতে টাকা-পয়সা ছিল না। আগে পেট বাঁচাতে হবে, তারপর যা হওয়ার তা হবে। চেনাজানা রাজনৈতিক লোকজন প্রথমদিকে ইপিআরের জওয়ানদের সঙ্গে ব্যারিকেড দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরোধ দেয়ার চেষ্টা করলেও প্রস্তুতি তেমন না থাকার কারণে পেছনে হটে গেছে সবাই। পদ্মা পার হয়ে ওদের অনেকেই সীমান্তের দিকে চলে গেছে। কেউ কেউ শিবগঞ্জের দিকে। আবদুল্লাহ যায়নি। বাজারে ওর একটা মুদি দোকান আছে। বাসায় বৌ আর ছোট দু’টো বাচ্চা আছে। এই দোকানের আয়ই তার একমাত্র ভরসা। হাতে টাকা-পয়সা থাকলে নরেনের পরিবারের সঙ্গে ও ভারতে চলে যেতে পারত, যারা গেছে তারা ওকে অনুরোধও করেছিল। কিন্তু তেমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই কঠিন কাজ ছিল আবদুল্লাহ্র জন্য। ভাগ্যকে তো আর পানির স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া যায় না। ওপারে কে আছে তার? এলাকার অনেকে আশাবাদী ছিল যে মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর যে আলোচনা ঢাকায় চলছে তা থেকে একটা ফলাফল পাওয়া যাবে। বাঙালির দাবির কাছে পশ্চিমাদের মাথানত করতেই হবে। কারণে সংসদে বাঙালির মেজরিটি ডিসেম্বরের ইলেকশনে নির্ধারিত হয়ে গেছে। পাকিস্তান টিকে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের এই ফলাফলের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে। মার্চের ওই সময়গুলোতে খুব আড্ডা চলত তার মুদি দোকানে। সবই রাজনৈতিক আলোচনা। পাশের দোকান থেকে চা আসত কাপ-কাপ, কলিমুল্লাহ্র চায়ের দোকান, গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে গরম আলোচনা চৈত্রের গরম বাতাসে মিশে যেত। এখন এক বিষণœ নীরবতা। সব সুনসান।
আবদুল্লাহ্ দোকান খোলে, দোকানের ওপর বাঁশের আগায় উড়িয়ে দেয় পাকিস্তানের পতাকা। মাথায় টুপি পরে। দাড়ি সে কখনও রাখার কথা চিন্তা করেনি আগে, এবার সেটাও রেখে দেয়। অন্তত নাপিতের পয়সাটা তো বাঁচবে। তাছাড়া, অরুণ শীল দোকান বন্ধ করে ওইপারে চলে যাওয়ায় চুল-দাড়ি কাটাও এখন সমস্যা হয়ে পড়েছে। তাই একমাত্র সমাধান ক্ষৌরকর্মে না যাওয়া।
দোকানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র ছবি টাঙিয়ে দেয় আবদুল্লাহ্। বাজারে এই দু’জনের ছবি কেনার হুড়োহুড়ি দেখে নিজেই তাজ্জব হয়ে যাচ্ছিল। কদিন আগেও যাদের ছবি নামিয়ে ভেঙেছে, থুতু দিয়েছে, অবলীলায় তা আবার পয়সা খরচ করে কিনে লাগাচ্ছে। কাচ বাঁধানো ছবি। ইয়াহিয়া নিজেও হয়তো জানে না তার ছবি কিনছে বাঙালিরা, দোকানে ঝুলিয়ে সম্মান দেখাচ্ছে তাকে। আহারে মানুষ।
দোকান খুলতেই প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো লাফিয়ে পড়েছে ওর দোকানে। চাল চাই, ডাল চাই, ছাতু চাই, মরিচ-পেঁয়াজের অত চাহিদা না থাকলেও কেরোসিন, লবণ আর দিয়াশলাই হু-হু করে বিক্রয় হচ্ছে। আবদুল্লাহ্ জানে, দু’চার দিনে তার স্টক শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ঢাকা-রাজশাহীর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ না হওয়ায় সাপ্লাই থাকবে না।
এখন ডিমান্ড বেশি, সাপ্লাই জিরো।
মাগরিবের আজানের পরপরই দোকান বন্ধ করে দেয় সে। বাসায় ফিরে যায়। হারিকেনটার সলতেটা ছোট করে দেয়, যেন আলো বাইরে না যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাকিস্তানি সৈন্য। সন্ধ্যা হলে মেশিনগান উঁচিয়ে বালির বস্তার পেছনে বসে থাকে। মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠা ‘হল্ট’ শব্দটা উড়িয়ে নিয়ে আসে ভারি বাতাস। প্রায় প্রতিদিনই দূর থেকে ফুটফাট গুলির আওয়াজ শোনা যায়। কে যে কাকে মারছে তা বোঝা যায় না। এক ধরনের ভয় চেপে বসে আবদুল্লাহ্র মনে। তার আশপাশের বাসাগুলো ফাঁকা, তবে পাড়ায় কিছু লোক এখনও আছে। একটু দূরে থাকে ওরা। আবদুল মজিদ আছে, নামকরা মুসলিম লীগার। দলবল নিয়ে হেঁটে বেড়ায়।
লোকটা একদিন তার দোকানে এসেছিল সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। ‘কী খবর আবদুল্লাহ্, ওপারে যাওনি? সবাই তো ইন্ডিয়া ভাগতেছে।’ ‘মজিদ ভাই কী যে বলেন। আমরা পাকিস্তানের মানুষ, ইন্ডিয়া যাব ক্যান?’
‘তোমার কথা শুইনা খুশি হইলাম মিয়া। আইজকাল মানুষ তো আর পাকিস্তানরে দ্যাশ মানে না, কয় বাংলাদেশ। তুমি তো মিয়া ভালোই বললা।’
কলিমুদ্দিনের দোকান থেকে চা আসে। বেঞ্চিতে বসে আবদুল মজিদ। চা খায়। ‘শোনো, মেজর সাহেবের সঙ্গে আমি কথা বলছি। চিন্তার কুনু কারণ নাই। তোমরা যারা পাকিস্তানরে ভালোবাসো, তাদের একটা তালিকা আমি তাকে দিবো। তোমাদের যাতে কুনু অসুবিধা না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব সেনাবাহিনী নিবে।’ আবদুল মজিদ আরও কী কী সব বলে।
‘তো মিয়া, তুমি মাথায় টুপি দিয়া ভালোই করছো। মুসলমান হয়া মাথায় টুপি দিবা না, এইটা ঠিক না।’
নিজের মাথার টুপিটা হাত দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে আবার বসায় আবদুল মজিদ। তার দলের সবার মাথায় টুপি। বেশ একটা ইসলামী আমেজ ফুটে উঠেছে।
‘নরেন ব্যাটা একটা আস্তা ইন্ডিয়ান এজেন্ট। ইন্ডিয়া গেছে, কিন্তু পুরা বাড়িটা সাফ কইরা নিয়া গেছে। একটা সুইও রাখে নাই।’
মিথ্যা কথাটা শুনেও আবদুল্লাহ্ চুপ করে থাকে। নরেন চক্রবর্তী চলে যাওয়ার সময় ওর সামনে দিয়েই গেছে। পরনের কয়টা কাপড় ছাড়া আর কিছুই নিতে পারেনি। চুলোর ওপর ভাত ফুটছিল, সে ভাতটা খাবারও সময় হয়নি ওদের। কামানের গোলা এসে পড়ছিল চতুর্দিকে। বাঙালিকে তাড়ানোর জন্য মেশিনগানের গুলি সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছিল চারপাশ দিয়ে। এমন গোলাগুলি ওরা জীবনে দেখেনি। আসলে নরেন চক্রবর্তী চলে যাওয়ার পর তার ঘর লুট করেছে আবদুল মজিদের লোকেরা। এ খবর তার কানেও এসেছে। এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো।
শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে সভা করে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, ন্যাপ এবং আরও অন্যান্য পার্টির লোকেরা। ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রক্ষায় তারা জনমত সংগ্রহে নেমে পড়েছে। একেই বলে রাজনীতি, আবদুল্লাহ্ বোঝে। যখন যার ক্ষমতা তখনই তার দাপট। পহেলা মার্চের পর এসব লোক ইঁদুরের মতো গর্তে পালিয়ে ছিল। এখন বীরদর্পে মঞ্চ দখল করেছে। বাঙালিকে ১৯৪৭ সালের গল্প শোনাচ্ছে।
আবদুল্লাহ্ মনে মনে হাসে।
দিন যায়, পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসন বাড়ে। পুরো দেশটাই মনে হয় দখল করে নিয়েছে পাঞ্জাবিরা। প্রথম প্রথম যারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল তারা কেউ আর দেশে নেই। হয় মারা পড়েছে, না হয় ওপারে চলে গেছে। ওয়াসেক মোল্লা, মোবারক হোসেন, কামাল বিশ্বাস, ঈমান আলী, আবদুল মজিদরা সংঘবদ্ধ হয়েছে। মহকুমা অফিসারের কাচারিতে মেজর সাহেবের ক্যাম্প। ওরা প্রায় প্রতিদিনই দল বেঁধে ক্যাম্পে যায়। নানা শলাপরামর্শ করে। নানা ফরমান জারি হয়।
নির্দেশ আসে আইডেন্টিটি কার্ড বানাতে হবে। লোকজন বলে ডান্ডি কার্ড। স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলে এলাকার সবাই, তারপর আবদুল মজিদের বাসায় যায় বাজারের লোকজন। সরকারি ফরমান অনুযায়ী সবার কাছে ডান্ডি কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক। রাস্তাঘাটে আর্মি নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, সেই বিড়ম্বনা এড়াতেই ডান্ডি কার্ডের প্রচলন করা হয়েছে। যাদের কাছে কার্ড পাওয়া যাবে না, তাদের ধরে নিয়ে যাবে আর্মি। কিছু পুলিশ আছে, টহলও দিচ্ছে, কিন্তু শাসন আর্মির, পুলিশের মূল্য কী? আবদুল মজিদ দায়িত্ব পেয়েছে ডান্ডি কার্ড ইস্যু করার।
একদিন সকালে দোকান খুলতে খুলতে কলিমুল্লাহ ফিস ফিস করে বলে, ‘স্বাধীন বাংলার রেডিও হয়্যাছে, শুনেছো?’ ‘কোথায়?’ ‘ক্যানো, শুনোনি?’
‘না তো?’ ‘বাসায় রেডিও আছে?’ ‘আছে।’
‘আজকে শুইনবা।’ আবদুল্লাহ আর বেশি কথা বলে না। রেডিও পাকিস্তান কিছুক্ষণ পরপরই আজকাল নসিহত করছে, দেয়ালেরও কান আছে। কোথায় কে কার কথা শোনে, আর সেটা পাকিস্তানি ক্যাম্পে পৌঁছে দেয় বলা মুশকিল, তখন জান নিয়ে টানাটানি। পাকিস্তান আর্মির লোকজন বাঙালিকে বিশ্বাস করে না, কোনো কথাই শোনে না ওরা, তথ্য পেলেই কাচারির পাশে একটা পুরনো দোতলা বাড়ি আছে, সেখানে নিয়ে গিয়ে টর্চার করে। তারপর রাতের আঁধারে মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে ব্রাশফায়ার করে লাশ ঠেলে দেয় নদীতে। মানুষজন অনেক লাশ দেখেছে নদীতে ভাসতে। গ্রীষ্মকাল বলে নদীতে পানি কম, লাশগুলো তাই ধীরগতিতে যায়। আতংকে কেউ কিছু বলে না। আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে।
চৌরাস্তায় সেদিন সদর কলেজের এক প্রফেসরকে আটক করেছিল আর্মিরা। বাংলার অধ্যাপক। উর্দু-ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে বলা কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি খান সেনারা। ‘কেয়া কারতা?’
‘বাংলা পড়াতা স্যার।’
সৈনিকগুলোকেও স্যার বলেছিল প্রফেসর। কিন্তু সব ছাপিয়ে খান সেনাদের কানে ‘বাংলা’ শব্দটাই ঢুকেছিল বোধহয়। আর কোনো কথা শোনার আগ্রহ দেখায়নি ওরা। চোখ বেঁধে হাত পিছমোড়া করে পাঠিয়ে দিয়েছিল টর্চার সেলে। তিন দিন পর তার লাশ নদীতে ভাসতে দেখেছিল লোকজন।
আবদুল্লাহ্ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে একটা। ছোট বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকায়। তার বউয়ের বয়স ত্রিশও হয়নি। তার মুখের দিকে তাকানো যায় না। আতংকে কেমন সিঁটিয়ে থাকে সব সময়। ওরা শুনেছে, সোমত্ত মেয়েদের ধরে ধরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে অখণ্ড পাকিস্তানের দাবিদার বাঙালিরা। প্রতিদিন এপাড়া-ওপাড়া ঘেরাও দিয়ে মেয়েদের আর যুবকদের খুঁজছে। যাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তারা আর ফিরে আসে না। সের-সের গরুর মাংশ আর রুটি যাচ্ছে অফিসারদের জন্য, আবদুল মজিদরাই সাপ্লাই দিচ্ছে সব। সারারাত ক্যাম্পে উৎসব চলছে। অন্ধকার শহরের বিপরীতে এমন দুর্লভ চিত্র খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। পাখির জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা, আবদুল্লাহ্র কষ্ট হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই তার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়ায় সাধ্য কার?
শহরে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। রাজাকার বাহিনীতে অশিক্ষিত যুবকদের আহ্বান জানানো হয় পাকিস্তান রক্ষায় কাজ করার জন্য। মাসে বেতন তিনশ’ টাকা। আবদুল মজিদ একদিন ডেকে পাঠায় আবদুল্লাহ্কে। ‘দোকানে মাসে আয় কতো?’ আবদুল্লাহ্ ঠিক বুঝতে পারেনি কেন তাকে এমন প্রশ্ন করা হচ্ছে। ‘এই ধরেন গিয়ে, দিয়ে-থুয়ে দুইশ’ টাকা তো হয়।’ ‘তুমি মিয়া তিনশ’ টাকা পাইবা, রাজাকার বাহিনীতে যোগ দ্যাও।’
আকাশ বাণী কলকাতা আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চুপ চুপ করে লো-ভলিউমে শোনে আবদুল্লাহ্। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর ইভা নাগ বাংলাদেশ নিয়ে নানা খবর দেয়। মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছে এ খবর ওখানেই শুনেছে সে। রীতিমতো ট্রেনিং নিয়ে ওরা যুদ্ধে নেমেছে। তাছাড়া, গেরিলা বাহিনী দেশের ভেতরে ঢুকে গেছে। মানুষজনের ভেতর থেকে আচমকা ওরা গ্রেনেড বা বোমা মেরে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। বহু খানসেনা মারা যাচ্ছে। পুল-ব্রিজ ধ্বংস করে দিচ্ছে মুক্তিবাহিনী। যেসব রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানিরা গোলাবারুদ আর রসদ নিয়ে যাচ্ছে সেসব জায়গায় অতর্কিত অ্যামবুশ করছে ট্রেনিং নেয়া ছেলেরা।
ওপার থেকে তার কাছে খবর পাঠিয়েছিল জয়নাল। যে লোকটা খবর নিয়ে এসেছিল তাকে আবদুল্লাহ্ কখনও দেখেনি। লোকটা মনে হয় মুক্তিবাহিনীর লোক। তার চোখের ভেতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। আবদুল্লাহ্র তখন মনে হয়েছিল, মুক্তিবাহিনীর চোখে বোধহয় আগুনই জ্বলে। জয়নাল বলেছিল লোকটাকে সহায়তা করতে। শান্তি কমিটির লোকজনদের চিনিয়ে দিতে। ওরা ওদের শেষ করে দেবে। জয়নাল দিনাজপুরে যুদ্ধ করছিল তখন। লোকটা পরে একদিন নিজেই বলেছিল, ও মুক্তিবাহিনীর লোক। ওদের দল আছে শহরের আশপাশে। বাড়ি নোয়াখালী। ওরা চাইছিল স্থানীয় লোকজনের সহায়তা। সাহায্য-সহযোগিতা পেলে ওদের কাজ করতে সুবিধা হবে।
আবদুল মজিদের প্রস্তাবে তাই একটা ঠোক্কর খেয়েছিল আবদুল্লাহ্।
‘মজিদ ভাই, ভাবতে একটু সময় দেন।’
‘যাও, সময় দিলাম। কিন্তু না করবা না। বোঝোই তো, তিনশ’ রাজাকার রিক্রুট করার অর্ডার দিছে মেজর সাহেব। তোমরা না করলে তোমাদেরই ক্ষতি হবে।’ ‘কিসের ক্ষতি?’ চমকে উঠেছিল আবদুল্লাহ্। ‘সময় হইলে বুঝবা মিয়া।’ কথার ভেতর একটা তাচ্ছিল্য ছিল তার। আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘দোকান বন্ধ করে পাকিস্তান পাহারা দিতে হবে?’ ‘পাকিস্তান তোমারে পাহারা দিতে হবে না, সেজন্যে আল্লাহ্তায়ালা আছেন। তোমরা রাজাকাররা পুল-ব্রিজ পাহারা দিবা আর মেজর সাহেবদের খেদমত করবা। পারবা না?’ ‘পারবা না’ শব্দটা খেঁকিয়ে ওঠার মতো মনে হয়েছিল আবদুল্লাহ্র। কিন্তু কিছুই করার নেই তার। রাজাকার বাহিনীতে যোগ না দিলে তার পরিবারের ওপর আঘাত আসতে পারে। আনারকলিকে পাড়ার সবাই চেনে। নিজের বৌ বলে নয়, আবদুল্লাহ্ জানে তার ঝকঝকা চেহারা যে কারও চোখে লাগার মতো। আনারকলির বিপদ হতেই পারে। মজিদ-মোল্লা-ঈমান আলীরা যা করছে তা কোনো মানুষে করে না।
জয়নালের পাঠানো লোকটা আবার আসে তার দোকানে। নাম তার দেলওয়ার। দেলওয়ার আবদুল্লাহ্কে বোঝায় এলাকায় নতুন বলে অনেকে তাকে দেখে সন্দেহ করতে পারে। সে যেন তাকে তার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই বলে পরিচয় দেয়। ডান্ডি কার্ড তার আছে। ভয় নাই। ঠিকানাটা শুধু মুখস্থ করে নিতে হবে তাকে। আর তার প্রয়োজনমতো কাজ করলে তার পরিবারের ওপর নজর রাখা মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব। দু’জনে ফিসফিস করে আরও কী সব শলাপরামর্শ করে।
দু’দিন চিন্তা-ভাবনা করে আবদুল্লাহ্ রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। রোজ সকালে উঠে পুলিশ লাইনে যায়, প্যারেড করে। লুঙ্গির ওপর খাকি শার্ট, কোমরে গামছা পেঁচিয়ে নিতে হয়। কাঁধে একটা দু’নলা বন্দুক। ডিউটির কোনো টাইম নাই। যখন-তখন ডাক পড়ে। রাস্তায়, নদীর ঘাটে, বাজারে, সরকারি অফিসের সামনে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ক্যাম্পে গেলে খাওয়া-দাওয়া ফ্রি। মাছ-মাংস কোথা থেকে যে আসে আল্লাহ্ জানেন। মাস গেলে নগদ তিনশ’ টাকা। দু’তিন মাস ভালোই চলে যায় আবদুল্লাহ্র। কিন্তু মনটা তার উসখুস করে। ভালো করে ঢোক গিলতে পারে না, মনে হয় গলায় কাঁটা আটকে গেছে। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে উদয় হয় দেলওয়ারের। ‘ভাই কি কিছু ভাবলেন?’ দু’জনে ফিসফিস করে আবার। আনারকলি আড়াল থেকে শোনে। বাচ্চা দু’টোকে বুকের কাছে চেপে ধরে। আগস্ট মাসের দিকে পানি বাড়ে নদীতে। বৃষ্টি শুরু হলে আর থামার লক্ষণ দেখা যায় না। একনাগাড়ে কয়েকদিন বৃষ্টি হলে খালেও পানি বাড়ে। তখন জেলা শহরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী রাস্তাগুলোর উপর সিএন্ডবি’র তৈরি কালভার্টগুলো ঝুঁকিতে পড়ে যায়। মেজর সাহেব এলাকার শান্তি কমিটির লোকদের নিয়ে জরুরি সভা করেন। রাস্তাঘাট অরক্ষিত রাখা যাবে না। রাজাকারদের টহল বাড়াতে হবে। আবদুল্লাহ্ শুনেছে পাকিস্তানের সেনারা পানিকে নাকি খুব ভয় পায়, অনেকে সাঁতারও জানে না। তাছাড়া, সাপখোপ এবং জোঁকের উপদ্রব সামলাতে পারলেও মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলায় তারা একেবারে কাবু হয়ে গেছে। তাই মেজর সাহেবের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাতের বেলা পাকিস্তানের গর্বিত সেনাবাহিনী বাংকারে এবং ক্যাম্পে থাকবে, বাইরে পাহারা এবং টহলের কাজ করবে বাঙালি রাজাকাররা। শহরের ভেতর কিছু বোমা ফাটা ছাড়া যদিও এখনও কোনো বড় অঘটন ঘটেনি।
আবদুল্লাহ্ রাত-বিরেতে ডিউটি করে বেড়ায়। পুল পাহারা দেয়। বিদ্যুৎ অফিসে, টেলিফোন অফিসে ডিউটি করে। একদিন মেজর সাহেবের কাচারি বাড়ি পাহারা দিতে হয় তাকে। আজ এখানে, তো কাল ওখানে। ভালোই ডিউটি, মনে মনে হাসে আবদুল্লাহ্।
রাজাকার কমান্ডার লতিফ খুব চালু। মুসলিম লীগ করে। গত বছর ইলেকশনের সময় এক ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কিছু লোক তাকে পিটিয়েছিল। ভাঙা পা নিয়ে বিছানায় পড়েছিল দুই মাস। কমান্ডার হওয়ার পর প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে। ওইসব লোকের বাড়ির একটা একটা করে ইট খুলে নিয়ে এসেছে, তারপর বসতভিটায় মই চালিয়ে সবজির ক্ষেত বানিয়েছে। সারাক্ষণ পান খায়, তার কষ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে লতিফের। সেই কষ দেখতে রক্তের মতো মনে হয় আবদুল্লাহ্র, মনে হয় জীবন্ত রাক্ষস।
‘কী ভাই আবদুল্লাহ্, তুমি ডিউটিতে ফাঁকি দিতেছো মনে হয়।’
লতিফের কর্কশ কণ্ঠস্বর। ‘ক্যান ভাই? ডিউটিতো পুরাই দিতাছি।’ ‘না মানে, তুমি যেদিন যেখানে ডিউটি দ্যাও, পরদিন সেইখানে ইন্ডিয়ান এজেন্টরা বোমা মারে। কেইস কী?’
‘আমি যেদিন ডিউটি দেই সেইদিন তো মারে না। তাইলে আমার দোষ কোথায়? যারা ডিউটি দেয় তাদের কন।’
আবদুল্লাহ্ জোর দিয়ে কথা বলায় একটু ভড়কে যায় কমান্ডার।
‘আরে না মিয়া, এমনিই কইলাম আর কী। পাকিস্তান রক্ষায় তোমার যে অবদান তুমি রাখতেছো, আমার সঙ্গে সঙ্গে জাতি তোমাকেও সেইভাবে স্মরণ করবে।’
আবদুল্লাহ্ এতদিনে বুঝে গেছে শক্তের ভক্ত নরমের যম কাকে বলে। নরম মানুষকে সবাই চিবিয়ে খায়। লতিফ কমান্ডার সুযোগ পেলেই ঘায়েল করতে চায় সবাইকে। মনে করে তার ক্ষমতাই বেশি। আসলে কার যে কোথায় ক্ষমতা সেটা একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন। তবুও আবদুল্লাহ্ নজরে রাখে লতিফ কমান্ডারকে। সাপের জাত। কখন ছোবল দেবে কেউ জানে না। তাকে সুযোগ দেয়া যাবে না। সে বুঝতে পেরেছিল লতিফের কান ভারি করা কথায় তার উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল মেজর সাহেব। সেদিন বাজারে তার ডিউটি ছিল। ওই বাজারে মেজর সাহেবের গাড়ির কাছাকাছি একটা বোমা বিস্ফোরণ হওয়ায় মেজর সাহেবকে তার কথাই বলা হয়েছিল। ভাগ্য ভালো ছিল তরুণ পাঞ্জাবি মেজর সাহেবের, জীবনে কী পুণ্য করেছিল কে জানে, তার গাড়ির ছাদে পড়া বোমাটা বিস্ফোরিত হয়নি। গাড়ি দ্রুত চলতে শুরু করলে ফাটা বোমাটা তার নাগালে পৌঁছুতে পারেনি। ভাগ্য ভালো আবদুল্লাহ্রও, মেজর সাহেবের কিছু একটা হয়ে গেলে তার জন্য একটা বুলেট খরচ করতে ওরা দ্বিধা করত না। কিন্তু সে জেরার মুখে পড়েছিল, নানা প্রশ্নে তাকে জর্জরিত করেছিল ক্যাপ্টেন সাহেব। সে থরথর করে কাঁপছিল। মৃত্যু দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশে।
আজ সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ ঘিরে আছে ঘন কালো মেঘ। আর পাঁচটা দিনের মতোই আর্মি অফিসাররা সুরায় ডুবে আছে কাচারি ক্যাম্পে। সুনসান রাস্তাঘাট। মাঝে মাঝে ‘হল্ট’ শব্দটি সচকিত করে দিচ্ছে সজাগ মানুষগুলোকে। আবদুল্লাহ্র ডিউটি পড়েছে কাচারি ক্যাম্পের সামনের রাস্তায়। যদিও ক্যাম্পের প্রবেশমুখে চারজন সৈন্য মেশিনগান নিয়ে পাহারায় আছে। লতিফ কমান্ডার এসে একবার ডিউটি চেক করে গেছে। ‘মিয়া, চোখ-কান খোলা রাখবা।’
চোখ-কান খোলাই রেখেছে আবদুল্লাহ্। কাচারি বাড়ির পেছনে একটা আমবাগান। বেশ বড় আমবাগান। ওখানেও বাংকার করে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয় সৈনিকরা। বাগানের সঙ্গে কাচারিবাড়ির দেয়ালটা ছিল চার ফুট উঁচু, সেটাকে সাত ফুট উঁচু করা হয়েছে। দেয়াল টপকে ভেতরে ঢোকা এখন বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। তাছাড়া, সার্চলাইট বসিয়ে পুরো দেয়ালটাকে দিনের মতো আলোকিত করে রাখা হয় সন্ধ্যা হলেই। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দলের অন্যদের রাস্তার ডিউটিতে রেখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ গান গাইতে গাইতে আবদুল্লাহ্ পেছনটা ঘুরে এসেছে একবার।
রাস্তায় ফিরে এসে সে একটা সিগারেট ধরায়। বগলা সিগারেট। আজ সে এক প্যাকেট কিনেছে। অথচ আবদুল্লাহ্কে কেউ কোনোদিন সিগারেট খেতে দেখেনি। সে একটার পর একটা সিগারেট খেতে থাকে। তাই দেখে মিনু রাজাকার জিজ্ঞেস করেছে,
‘আবদুল্লাহ্ ভাই, সিগারেট খাইতাছো যে?’
এমন প্রশ্ন আসবেই। জবাবও প্রস্তুত ছিল তাই তার মুখে।
‘দেখতাছো না, কেমুন জার লাগতেছে, তাই শরীলডারে গরম কইরা নিতাছি।’ ‘সিগারেট খাইলে শরীল গরম হয়?’
‘হয় কি না, খায়া দেখো।’ একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়েছিল মিনুর দিকে আবদুল্লাহ্। ‘না-না, খামু না। মাথা ঘুরে।’ রাজাকারের একটা দল তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা পাঁচজন। বৃষ্টি বলেই হয়তো গামছা দিয়ে মুখের নিচ দিক ঢাকা। গায়ে চাদর। অন্য কোথাও ডিউটিতে যাচ্ছে হয়তো। আবদুল্লাহ্ চুপ করে থাকে। মিনু রাজাকার জিজ্ঞেস করে, ‘কারা যায়?’ ‘আমরা।’ আবদুল্লাহ্ স্পষ্ট বুঝতে পারে ওটা দেলওয়ারের কণ্ঠ। ‘আমরা কারা?’ ‘নতুন রাজাকার। চৌহালি থাইকা আইছি।’ ‘ও আচ্ছা।’ প্রশ্ন শেষ মিনু রাজাকারের। কিন্তু মুহূর্তেই পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা চাদরের তলা থেকে ছুরি বের করে বুক বরাবর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় আবদুল্লাহ্র সঙ্গে থাকা তিন রাজাকারের। মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশগুলোকে টেনে ড্রেনে ফেলে দেয়। আবদুল্লাহ্ হাত লাগায় ওদের সঙ্গে। মুহূর্তের মধ্যে দলটি কাচারি গেটে গিয়ে একই কাজ করে। চার সেন্ট্রির লাশ বালির বস্তায় চাপা দিয়ে দু’জন স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে যায়, অন্য তিনজন সামনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
পুরো ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। এক মিনিটের মাথায় ফিরে আসে ওরা। তারপর পাঁচজন একপ্রকার দৌড়ে তার কাছে আসে। পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা স্টেনগান হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে।
দেলওয়ারই বলে,
‘আবদুল্লাহ্ ভাই, মেজর শ্যাষ। গুলি খরচ করি নাই, তারেও খরচ করতে দেই নাই। ছুরি ঢুকায়া দিছি প্যাটে।’
সিগারেটের প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে দেয় আবদুল্লাহ্। দেলওয়ার এবং মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের কাছে তার সিগারেটের আগুন ছিল গ্রিন সিগন্যাল। তাদের অনেক দিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে।
আর দাঁড়ায় না ওরা। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় করে ওরা দ্রুত সরে যেতে থাকে অবরুদ্ধ শহর থেকে। আবদুল্লাহ্ ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। পেছনে পড়ে থাকে তিন রাজাকার, পাকিস্তানি মেজর আর তার সৈনিকদের লাশ।
আনারকলি বাচ্চাদের নিয়ে এতক্ষণে নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে গোবিন্দপুর। রাজাকার আবদুল্লাহ্র খোঁজ পড়ার আগেই তাকে গোবিন্দপুর পৌঁছে যেতে হবে। সেখান থেকে সীমান্ত বেশি দূরে নয়।

No comments

Powered by Blogger.