গ্রিসের তরুণেরা পারে, আমরা কেন পারি না? by ফারুক ওয়াসিফ

বিভিন্ন জাতির তরুণেরা যখন জাগতিক অর্থনৈতিক প্রশ্নে আকুল ও ব্যাকুল, তখন বাংলাদেশি তরুণেরা ব্যস্ত মতাদর্শ ও আবেগের টানাটানিতে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশি তরুণেরা বেশি আলোড়িত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামের নামে। এতে তাদের বাস্তব অবস্থার উন্নতির বদলে বিকাশের পথ আরও কঠিনই হয়ে গেছে। একের পর এক আনাড়ি আলোড়নে দেশ বিভক্ত হয়েছে, রাজনীতি সহিংস হয়েছে এবং তার ধাক্কা গিয়ে লেগেছে অর্থনীতিতে। রাজনৈতিক মুক্তি অথবা অর্থনৈতিক উন্নতির দাবি এসব আলোড়নের কেন্দ্রে আসতেই পারেনি। অন্যদিকে গ্রিক তরুণেরা অর্থনৈতিক বঞ্চনা আর জাতীয় অপমানের বিরুদ্ধে আলোড়িত হয়ে সরকার বদল ঘটিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশি তরুণদের শাহবাগ ও শাপলার জাগরণ ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রশ্নের স্থায়ী মীমাংসার বদলে তাকে আরও জটিলই করেছে। পুরোনো রাজনৈতিক শক্তিগুলো দুর্বল না হয়ে বরং আরও জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে গ্রিক তরুণেরা নির্বাচনের মাধ্যমে পুরোনো শাসকদের সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় পাঠিয়েছে নতুন বামপন্থী দলকে। বাংলাদেশে রংবেরঙের যত রকম গণতন্ত্র এসেছে, তাতে ‘রাজবংশীয়’ মহানায়কেরাই জনগণকে চালিয়েছে; বিপরীতে গ্রিসে জনগণ নিজেরাই চালানো শুরু করেছে তাদের গণতন্ত্র। বাংলাদেশে নেতা হতে গেলে অন্তত তিন দশকের অভিজ্ঞতাবান প্রবীণ হতে হয়, আর গ্রিসের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাত্র ৩৩ বছর বয়সে দলপ্রধান হয়ে সেই দলকে সাত বছরের মধ্যে ক্ষমতাসীন করেছেন। সরলবর্গীয় বৃক্ষেরা কেউ কারও ছায়ায় বাড়তে পারে না। বাংলাদেশেও তেমনি মহিরুহ ব্যক্তিত্বের চাপে তরুণেরা সামনে বাড়তে পারছে না। গ্রিকরা তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নয়া রাজনৈতিক দল পেয়েছে, বাংলাদেশে জাগরণের পর জাগরণ হয় কিন্তু নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতে পারে না। যাদের দ্বারা তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রতারিত, এসব জাগরণ তাদের অবস্থানকেই আরও সংহত করেছে। জনগণের ভেতর থেকে নতুন দল গড়ে তোলা কিংবা মতাদর্শের ছাউনি থেকে বেরিয়ে বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ায় আমাদের পরিবর্তনকামীদের বিপুল অনীহা। গ্রিক উপকথায় তারুণ্যের জয়জয়কার, বাংলাদেশের রূপকথা ও ইতিহাসে তরুণেরা কাজলরেখার মতো কেবলই প্রতারিত হয়। ইতিহাসের দেবতা কেবল আমাদের তরুণদের রক্তই পান করেন, বিনিময়ে সৌভাগ্যের বর দিতে তাঁর কৃপণতার কোনো সীমা নেই। গ্রিক রাজা সিসিফাস দেবতার অভিশাপে অনন্তকাল ধরে পাহাড় বেয়ে পাথর তুলতেন আর শিখরের একেবারে কাছ থেকে পতিত হতেন। গ্রিসের আধুনিক ইতিহাসের সব পরিবর্তনের চেষ্টাও এভাবে বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। বারবারই জিতে গেছে অভিজাততান্ত্রিক দুর্নীতিবাজ সরকার। বারবারই তাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে পশ্চিম ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো। তাদের দেওয়া একের পর এক ভুল ওষুধে রোগ আরও দুরারোগ্য হয়েছে। আইএমএফ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে চলতে গিয়ে গ্রিস অর্থনৈতিকভাবে আত্মহত্যার পথে ধাবিত হচ্ছিল। একসময় তুরস্ককে বলা হতো ইউরোপের বিমারি মানুষ (সিক ম্যান অব ইউরোপ)। সম্প্রতি এই তকমা গ্রিসের গায়েই সেঁটে ছিল। বেকারত্ব, অস্থিতিশীলতা, জাতিবিদ্বেষের ভাইরাসে গ্রিস সত্যিই হয়ে উঠেছিল রুগ্ণ অর্থনীতি ও গণবিরোধী রাজনীতির করুণ কারখানা। গ্রিসের সিসিফাসীয় এই নিয়তি লঙ্ঘন যখন অসম্ভব মনে হচ্ছিল তখনই উদয় ঘটল পুঁজিবাদবিরোধী বামপন্থী সিরিজা পার্টির। ‘সবাই অবাক সবাই ভাবে ব্যাপারখানা কী! ভয়কাতুরে মাহবুব আজ দারুণ সাহসী!’ ছোটবেলায় পড়া সেই কবিতাটাই যেন ফলে গেল। এক দশকের বঞ্চনা, জাতীয় অপমান আর নৈরাশ্য ছিঁড়েফুঁড়ে তারা গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম দিল। গ্রিকরাই গণতন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল, গণতন্ত্রকে পুনরায় উদ্ভাবনের কৃতিত্বটাও তাদেরই। এবং সেই গণতন্ত্র এখন পুুঁজিবাদকে লাগাম পরাতে চাইছে। বিশ্বজুড়ে অনেক পণ্ডিতই বলাবলি করছিলেন, বিরাটাকায় কোম্পানিগুলোর চরম পুঁজিবাদের সামনে গণতন্ত্রের টিকবার উপায় নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অনেক প্রতিশ্রুতিই গরল ভেল হয়ে গেছে করপোরেট শক্তির দাপটে। ভারতের নরেন্দ্র মোদি অতিকায় ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলোর সমর্থনে ক্ষমতাসীন হয়ে তাদের জন্যই কাজ করে যাচ্ছেন। চীনের পুঁজিবাদ শক্তিশালী হয়েছে গণতন্ত্রকে দূরে রেখেই। বৈশ্বিক মন্দার সময়ও এই প্রশ্ন উঠেছিল, গণতন্ত্র যদি পুঁজিবাদকে সামলাতে পারত, তাহলে কতিপয় ব্যবসা-গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে ভুগতে হতো না; মন্দায় পড়ত পুঁজিবাদের কেন্দ্র-দেশগুলো। পুঁজিবাদ আর গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে না—এই স্লোগান উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটবিরোধী অকুপাই আন্দোলনে। বাংলাদেশেও অনেকের বিশ্বাস, পুঁজিবাদী পথে উন্নতি করতে হলে গণতন্ত্রের দরকার নেই। এরই উত্তর দিল গ্রিস। তারা দেখাল লাগামছাড়া মুনাফা পুঁজি ও শ্রমিক উভয়কেই বিপদে ফেলে, একে সামলাতে হবে। এই যুক্তি দেখিয়ে পুঁজিবাদবিরোধী বাম দলের বিজয় কলি উল্টানো ঘটনাই বটে। আর এই বিজয় গ্রিসের প্রায় শতবর্ষ পুরোনো কমিউনিস্ট পার্টির ভুল আর আপসেরও জবাব। গ্রিসের তরুণ প্রধানমন্ত্রী সিরিজা পার্টির নেতা আলেক্সিস সিপ্রাসসহ জয়ীদের অনেক নেতাই পুরোনো কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বাম মূল্যবোধ ও চিন্তার জন্ম দিয়েছেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী ১৩টি ছোট বাম দলের সমন্বয়ে প্রথমে ঐক্যের আলোচনা শুরু করেন। তারপর ধাপে ধাপে আন্দোলনের জোট থেকে নির্বাচনী জোট হয়ে একীভূত পার্টি করেন মাত্র ২০১২ সালে। দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনে জেতেন। এই দলগুলো নেতাকে পির বানায়নি, কর্মী-সমর্থকদের কথা এখানে উপেক্ষিত হয় না। আস্তিক-নাস্তিকতা কাজিয়ায় মাতে না তারা। এসব গুণেই তারা শতবর্ষ পুরোনো অচলায়তনকে ধাক্কা দিয়েছে। দেশটির সনাতন শাসকেরা পরাশক্তির হাতের পুতুল হয়ে যা-ই করছিলেন, অধঃপতন ততই গতি পাচ্ছিল। বেকারত্ব ধাঁই ধাঁই বাড়ছিল, অর্থনীতির মেরুদণ্ড গলে যাচ্ছিল, বাড়ছিল আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কাছে জাতীয় লাঞ্ছনার দৈর্ঘ্য। আর এসবের খেসারত দিচ্ছিল তরুণ ও শ্রমজীবী জনসাধারণ। গ্রিসে তরুণ িনম্ন মধ্যবিত্ত প্রিক্যারিয়েত ও শ্রমিক প্রলেতারিয়েতের জোটবদ্ধতাই এ বিজয়ের মূল চাবিকাঠি। বাংলাদেশের প্রিক্যারিয়েতরা শাহবাগ-শাপলায় মুখোমুখি লড়ে যখন–তখন শ্রমিকেরা রানা প্লাজায় তাজরীনে মরে আর নিঃসঙ্গ আন্দোলন করে। পরিণতিতে পরাস্ত হয় উভয়ই, কিন্তু শেখে না কেউই। গ্রিক সিরিজা আমাদের মতো দেশের অতিবিপ্লবী বা সুবিধাবাদী বাম নয়, নয় বাস্তবতা বিযুক্ত কল্পনাতাড়িত। তারা সংকটের জন্য দায়ীদের সঙ্গে কোনো রকম আপস করেনি। মতাদর্শের ভিত্তিতে নয়, কর্মসূচির ভিত্তিতে জোট গঠন করে দেখিয়েছে, তারা নীতির সঙ্গে আপস করেনি, বরং নীতিগত আপস করেছে। তৃণমূল থেকে জাতীয় নির্বাচন, আন্দোলনের জোট থেকে নির্বাচনী জোট হয়ে পার্টি গঠনের পথে তারা ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ হয়েছে। সিরিজার আপাতত উদ্দেশ্য রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল উচ্ছেদ নয়, বরং রাষ্ট্রটাকে পরাশক্তি ও দেশীয় অভিজাতদের দখলমুক্ত করে জনগণকে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া। দ্বিতীয়ত, জাতীয় আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। তৃতীয়ত, গ্রিসের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা প্রশ্নে নিরাপস জাতীয় ঐক্য গঠন করা। সে জন্যই ইউরোপীয় কমিশন, আইএমএফ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ত্রিশূল শক্তির সঙ্গে সম্পাদিত অবমাননাকর চুক্তি বাতিলের ডাক দিয়েছিল। সেটাই কোটি কোটি গ্রিক তরুণের মনে আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের তরঙ্গ নিয়ে আসে। তারই ফল, বিশ্বায়িত পাশ্চাত্যে প্রথমবারের মতো কোনো সমাজতান্ত্রিক দলের নির্বাচিত হওয়া। একদিক থেকে সোভিয়েত–পরবর্তী বামপন্থীরাও সিসিফাসের মতো ট্র্যাজিক। অনেক ত্যাগের পরও লক্ষ্যের কাছাকাছি অবস্থা থেকে ভুল বা আপসের কারণে পতন ঘটছে তাদের। পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম, নেপালের মাওবাদী কিংবা পর্তুগাল ও স্পেনের বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস এই চিত্রই তুলে ধরে। এদিক থেকে সিরিজা পার্টি যেন সিসিফাসীয় বাম পন্থার অভিশাপ কাটানো প্রথম বিজয়। স্পেন ও পর্তুগালের পরিবর্তনকামীরা গ্রিস থেকে ভরসা পাচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণেরাও গ্রিক ট্র্যাজেডির এই বদলে যাওয়া থেকে শিখতে পারে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.