রহমান শেলীর ইজ্জতের রশি

ব্যক্তিজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা লেখালেখির প্রধান সহায়ক। সম্ভবত এ কারণেই আল মাহমুদ বলেছেন- গ্রাম বাংলাকে এত ভালোভাবে না দেখলে তিনি কবি হতে পারতেন না। শুধু পঠনই লেখালেখির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে না। তাই জসীমউদ্দীন বলেছেন- শুধু পড়ে নকশিকাঁথার মাঠের মতো কাব্যগ্রন্থ লেখার মতো জ্ঞানী সাহিত্যিক তিনি নন। ঠিক একই কারণেই হয়তো বলা যায়- কবি রহমান শেলীর ক্রাইম ফিকশন লেখার প্রচেষ্টা। বর্তমান প্রযুক্তির যুগের সূচনা সাহিত্যের প্রথম ধাপে প্রবেশ করে ক্রাইম ফিকশন দিয়ে। তারপর দ্বিতীয় সাইন্স ফিকশন ধাপে প্রবেশ করে। আর পরবর্তী ও শেষ ধাপে সংযোজন হয় ক্লাইমেট ফিকশন। এভাবে সাহিত্যে গদ্যের স্পেসিফিকেশন বা নির্ধারণ অতীতে ছিল না। বিশেষত বাংলা সাহিত্যে ফেলুদার পর দ্বিতীয়বার ক্রাইম ফিকশনের প্রচলন হয়তো ইজ্জতের রশির মধ্য দিয়েই ঘটেছে। ক্রাইম ফিকশনের শাখা- গোয়েন্দা গল্প উপন্যাস, থ্রিলার উপন্যাস, আদালতের নাটক ও রোমহর্ষক ভয়ংকর অপরাধমূলক গল্প। ডিটেক্টিভ উপন্যাস ও গল্পে সাধারণত ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও অপরাধের চিত্র উপস্থাপনের পাশাপাশি অপরাধীকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা থাকে বা থাকে সমস্যার সমাধান। আর সাধারণ এ দিকগুলোর সঙ্গে শার্লক হোমস ও ফেলুদার মাধ্যমে আমরা ভালোভাবে পরিচিত। কিন্তু মূল ক্রাইম ফিকশনে থাকে ঘটনা ঘটে যাওয়ার চিত্র, অপরাধের চিত্রায়ন, অপরাধীর মোটিভ ও ডিকটেটশন। গোয়েন্দা গল্পের মতো এতে নির্দিষ্ট কোনো সমাধান নাও থাকতে পারে। আর তাই সাধারণত প্রশ্ন হতে পারে- এত ডিটেক্টিভ উপন্যাস বা গল্প থাকতে পাঠক কেনো ক্রাইম ফিকশন পড়বে। এ কারণটি অনুসন্ধান করতে রহমান শেলীর লেখক সত্তার পাশাপাশি পেশাগত দায়িত্বও ভূমিকা রেখেছে। দায়িত্ব নিয়েছেন বাস্তব ঘটনার সঙ্গে সংযোজন করে সাহিত্যের আঙ্গিকে ও শিল্পে পরিবর্তন সাধনা করার। কিন্তু তার সফলতা কতটুকু- তা বলতে পারবে পাঠক। কারণ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্যাত্রিক মোদিয়ানো নোবেল বক্তব্যেই বলেছেন- পাঠক লেখকে আরও বেশি ভালোভাবে জানেন তার লেখা উপন্যাস পড়ে। এবার এই ছোটগল্প সংকলন বা ক্রাইমফিকশন সংকলন ইজ্জতের রশিতে আসা যাক। এখানে লেখক অধিকাংশ ঘটনার পেছনের ঘটনা বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে তুলে ধরেছেন- কী সংকেত ধরে পুলিশ যে কোনো সমস্যার সমাধান করে। যেমন ফটোগ্রাফি। এ গল্পটি পড়ার পর মনে হবে- কী রহস্যই না যেন পাঠকের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু পাঠ শেষে মনে হবে কোনো রহস্য নেই। রোমহর্ষক উত্তেজনা তৈরি করে এভাবে পাঠককে ধরে রাখার কৌশলটা হুমায়ূন আহমেদের। এ কৌশলটি যে ক্রাইম ফিকশনেও ব্যবহার করা যায়- তা সফলভাবে দেখিয়েছেন রহমান শেলী। সাকলাইনের জিডি গল্প পাঠের পর মনে হবে- এ তো ঢাকার সাধারণ মধ্যবিত্তের প্রতিদিন পুলিশি তদন্ত মামলা করে হয়রান হওয়ার চিত্র। এ ক্ষেত্রে বলা যায় স্পাই গল্পটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারণ এতদিন আমরা শুধু গোয়েন্দাদের ছদ্মবেশে তথ্য সংগ্রহের গল্প শুনতাম। আর এ গল্পের বাস্তবতা উঠে এসেছে কীভাবে সিআইডি আত্মপরিচয় গোপন রেখে সত্য বের করার মতো দুঃসাধ্য সাধন করেন। কিন্তু এ গল্পটি পড়ে সহজেই লেখকের লেখার মাঝে এক ধরনের তাড়াহুড়ো ভাব অনুভব করা যায়। মনে হয় এ গল্পটি অনেক ক্ষেত্রে রিপোর্টিংয়ের কাছাকাছি। গল্পটি যদি এত তাড়াতাড়ি শুরু হওয়ার আগে শেষ না করা হতো, তবে আরও ভালো লাগত।
এতসব গল্পের মাঝে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গল্পটি বলা যায় ট্রিপল জিরো। এখানে পুলিশের এসিপি আসাদ গাড়ি চোর চক্রের প্রধানের সঙ্গে রসালাপে মেতে ওঠে। এ গল্পটি সত্যিই অসাধারণ। কারণ এখানে রহমান শেলী নামের যে হাস্যোজ্জ্বল রসিক মানুষটির বাস্তব চরিত্র সরাসরি ফুটে উঠেছে। যদি লেখকের সঙ্গে কোনো পাঠকের পূর্বপরিচয় ঘটে, তবে তিনি সহজেই বলে দিতে পারবেন এটি লেখক নিজে। ইজ্জতের রশি গল্পটিও এ ক্ষেত্রে কম যায় না। লেখক ইচ্ছে করলে এ গল্পটির সমাপ্তি টানতে পারতেন। কিন্তু তিনি টানেননি। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন- পুলিশ নয়, পুলিশের স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনই মূলত পুলিশের মান-সম্মানের রক্ষক। আর ইজ্জতের রশি হচ্ছে তারই প্রতি ইঙ্গিত। অন্যদিকে সপ্তম গল্প মোডাস হচ্ছে সমাজে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া ভুলগুলোর একটি। কারণ লেখক লেখেন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। তিনি কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে হলের ছাত্রদের মাধ্যমে কীভাবে অপরাধ সংগঠিত হয়, তার ধারণা অনেকেরই নেই। এ বাস্তবতা বুঝাতে তিনি সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- কারা ঘটনার অনুঘটক। রাজনীতির বিষাক্ত গোখরা কীভাবে দংশন করে নিজের প্রয়োজনে শিক্ষা ব্যবস্থাকে, তার বাস্তব উদাহরণ এ গল্প। শুধু তাই নয়, নামকরণেও আমরা এক ধরনের কাব্যিক ভাবের ভূমিকা পাই এ বইয়ে। যেমন একটি আত্মহত্যার হত্যা। অর্থাৎ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া একটি মেয়েকে কীভাবে মা মানসিক সমর্থন দিয়ে বাঁচাতে পারেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সামাজিক পটভূমি ভেঙে-গুঁড়িয়ে দিয়েই মূলত সাহিত্য সম্ভব নয়। বরং সাহিত্য হচ্ছে সমাজের কাঠামোর দুর্বলতা ও বাস্তবতা বোঝানো। যেমন নাগরিক বাস্তবতা বুঝে আসে হুমায়ূনের হিমুর মাধ্যমে, তেমনি অপরাধ বাস্তবতা বুঝতে হলে আমাদের কিছুটা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে ক্রাইম ফিকশন ইজ্জতের রশি। অবশেষে বলব- একটু সময় নিয়ে যদি লেখক আবার গল্পগুলো দেখেন- তবে হয়তো বাংলা সাহিত্যের জন্য আমরা অনন্য সংযোজন পাব বলে আশা করতে পারি।
বই
ইজ্জতের রশি
রহমান শেলী

No comments

Powered by Blogger.