হতাশায় ভুগছিলেন টুনি by রুদ্র মিজান

না, কোন সমস্যা নেই আম্মু ঘুমিয়ে আছেন।’ কথাগুলো বলেছিল নায়ার সুলতানা লোপার কন্যা ৯ বছর বয়সী আনায়া আমিন। কিন্তু ততক্ষণে তার মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লোপার মৃত্যুর খবর পেয়ে গুলশানের ১২৬ নম্বর সড়কের ১২ নম্বর বাড়িতে যায় পুলিশ। ওই বাসার দায়িত্বে থাকা এসেট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সুপারভাইজার মুহাম্মদ হাসান তখন কিছুই জানতেন না। পুলিশ জানায়, ফ্ল্যাট-সি থ্রিতে সমস্যা হয়েছে। হাসান ইন্টারকম থেকে কল করলে আনায়া আমিন তা রিসিভ করে এই কথাগুলো বলে। এর মধ্যেই এসে উপস্থিত হন লোপার স্বজনরা। পরে পুলিশ গিয়ে লোপার লাশ উদ্ধার করে।

আশির দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের টুনি চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন সেদিনের ছোট্ট লোপা। নাটকে ক্যান্সার আক্রান্ত টুনি চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদকে চিঠি লিখেছিলেন দর্শকরা। সেই টুনি চরিত্রের লোপার এমন করুণ মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে। এটি হত্যা না আত্মহত্যা- এ নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন লোপার পরিবারের সদস্যরাও। প্রথমে এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বললেও পরে হত্যাকাণ্ড দাবি করে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন লোপার মা রাজিয়া সুলতানা। এতে লোপার স্বামী আলি আমিন, শ্বশুর আমিন আলী ও শাশুড়ি ইয়াসমিন আমিনকে আসামি করা হয়। অভিযোগ করা হয়, লোপার স্বামী আলি আমিন একজন মাদকাসক্ত। বিয়ের পর থেকেই তিনি লোপাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। এই নির্যাতনের বিষয় আলি আমিনের মা-বাবা জানলেও তারা তাদের পুত্রকে প্রশ্রয় দিতেন। দু’টি সন্তানের দিকে তাকিয়ে আলি আমিনের সকল অত্যাচার সহ্য করতেন লোপা। সর্বশেষ লোপাকে মারধর করে হত্যা করে ফ্যানের সঙ্গে তার লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে লোপার মা এজাহারে উল্লেখ করেন। এ ঘটনায় আলি আমিনকে পুলিশ আটক করে আদালতে হাজির করে। আদালতে পুলিশ তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। কিন্তু ততক্ষণে মামলার বাদী লোপার মা রাজিয়া সুলতানা তার অবস্থান পরিবর্তন করেন। তিনি নিজেই আদালতে আলি আমিনের জামিনে মুক্তি চান। ফলে আদালত তার রিমান্ড নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠান। এটি হত্যা না আত্মহত্যা-এ বিষয়ে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, নিহতের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। তবে পুলিশের ধারণা এটি আত্মহত্যা। সূত্রমতে, নিহতের পরিবারও মনে করছে এটি আত্মহত্যা হতে পারে। কিন্তু কি কারণে আত্মহত্যা করলেন লোপা এ বিষয়ে নিহতের পরিবারের ঘনিষ্ঠরা জানান, চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আমিন আলির পুত্র আলি আমিনের নিজের আয়ের কোন উৎস নেই। তিনি কোন চাকরি বা ব্যবসা করেন না। সংসার চালাতেন বাবার দেয়া টাকায়। গুলশানের যে ফ্ল্যাটে তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন তা-ও তার বাবা কিনে দিয়েছেন। বেকারত্বের কারণে বেশির ভাগ সময় বাসায় কাটাতেন আলি আমিন। স্ত্রী লোপার সঙ্গে ঝগড়া লেগেই থাকতো তার। স্বামী বেকার হওয়ায় প্রতিবেশী ও স্বজনদের কাছে লজ্জা পেতেন লোপা। যদিও বাবার চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন আলি আমিন। তাকে প্রায়ই কিছু একটা করতে বলতেন লোপা। এছাড়াও আলি আমিন একজন মাদকাসক্ত। মাতাল হয়ে সামান্য কথাকাটাকাটিকে কেন্দ্র করে প্রায়ই লোপাকে মারধর করতেন তিনি। ঘটনার দিনও তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে বলে তাদের একজন প্রতিবেশী জানিয়েছেন। পুলিশের ধারণা লোপার মৃত্যুর আগে আলি আমিন তাকে মারধর করেছেন। যে কারণে লোপার বাম হাতে ও গলায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ কারণেই ক্ষোভে-হতাশায় লোপা আত্মহত্যা করতে পারেন বলে তার ঘনিষ্ঠজন ও পুলিশের ধারণা।
ঘটনার সময় বাসায় নায়ার সুলতানা লোপা ও আলি আমিন দম্পতির দুই শিশুকন্যা ও বাসার গৃহপরিচারিকা লুবনা উপস্থিত ছিলেন। গতকাল দুপুরে ওই বাড়িতে গেলে নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, ওই বাসায় গৃহপরিচারিকা লুবনা ও দুই শিশু ছাড়া কেউ নেই। এসময় লুবনার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা নিষেধ আছে বলে জানান। সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার সময় লুবনা ও দুই শিশু সন্তান অন্যকক্ষে থাকায় তারা বিষয়টি বুঝতে পারেনি। পরে লোপাকে খুঁজতে গিয়ে গৃহপরিচারিকা ফ্যানের সঙ্গে তাকে ঝুলন্ত দেখতে পায়। তাৎক্ষণিকভাবে তা ফোনে লোপার মা রাজিয়া সুলতানাকে জানানো হয়। এরই মধ্যে খবর পেয়ে পুলিশ ওই বাড়িতে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে। গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক আসাদুজ্জামান জানান, লাশটি লোপার ঘুমানোর কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে সবুজ-নীল রঙের জর্জেট শাড়ি দিয়ে গলায় প্যাঁচানো অবস্থায় ছিল। তবে তার পা দু’টি বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে ছিল। এ বিষয়ে পুলিশ জানিয়েছে, অনেক সময় মানুষের মৃত্যুর পর দড়ি বা শাড়ি কিছুটা ঝুলে যায়। এ কারণে এটা হতে পারে। দীর্ঘ সময় লোপার লাশ এভাবে ঝুলে ছিল। লোপার মা রাজিয়া সুলতানার মতে, ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটা থেকে ৩টার মধ্যে। কিন্তু  গৃহপরিচারিকা তা বুঝতে পারে সন্ধ্যায়। গত শুক্রবার ময়না তদন্ত শেষে বনানী কবরস্থানে নিহতের লাশ দাফন করা হয়েছে।
২০০০ সালে চট্টগ্রামের বেঙ্গল তোয়ালে ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আমিন আলির পুত্র আলি আমিনের সঙ্গে বিয়ে হয় রাজধানীর গুলশান ১-এর নিকেতনের সি ব্লকের চার নম্বর সড়কের বাসিন্দা মৃত ইদরিস আহমদের কন্যা নায়ার সুলতানা লোপার। তাদের গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলায়। আলি আমিন ও লোপা দম্পতির আনায়া আমিন ও আজারা আমিন নামে দুই শিশুকন্যা রয়েছে। তারা গুলশানের সিজিএস স্কুলে অধ্যয়নরত।

No comments

Powered by Blogger.