নতুন সিল্ক রোড নির্মাণের পথে চীন by শশী থারুর

‘সিল্ক রোড’ শব্দবন্ধটি এক রোমান্টিক চিত্রকল্পের অবতারণা করে। এর অর্ধেক ইতিহাস আর অর্ধেক রূপকথা। দৃশ্যটা এ রকম: উটের কাফেলা কেন্দ্রীয় এশিয়ার পথহীন মরুভূমির মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই সিল্ক রোড শুধু পৌরাণিক অতীতের অংশ নয়, এটা চীনের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। স্থল ও সমুদ্রপথ উভয়ই এই ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের অংশ। এর মাধ্যমে দক্ষিণ ও পূর্ব এশীয় পণ্য ও চিন্তা ইউরোপে চালান হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে চীনা চা, কাগজ, গানপাউডার ও কম্পাস। আবার বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ও ভারতীয় সংগীতের মতো সাংস্কৃতিক পণ্যও চালান হয়েছে এ পথে। একইভাবে এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদ ও হারবাল ওষুধের সঙ্গে চীনাদের পরিচয় ঘটেছে। চীনারা আবার এসব জিনিস বৌদ্ধ ও ইসলামি সংস্কৃতিতে চালু করেছে। এই সিল্ক রোড ছিল মূলত স্থলপথ, এটা আরবের মধ্য দিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে চীনের অ্যাডমিরাল ঝেং হের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ভারত মহাসাগরে সাতবার চক্কর দিয়েছে। এরপর দেখা যায়, চীনা বাসনকোসন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরালার নারীদের প্রিয় জিনিসে পরিণত হয়। চীনা মাছ ধরার জাল এখনো কোচিতে ব্যবহৃত হয়।
১৪১১ সালে ঝেং শ্রীলঙ্কার উপকূলীয় শহর গলের কাছে একটি পাথরের ফলক নির্মাণ করেন। এতে চীনা, ফারসি ও তামিল ভাষায় লেখা ছিল। আসলে ওই ফলকে হিন্দু দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছিল, যাতে ঝে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে একটি দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ৬০০ বছর পর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একই পথে হাঁটছেন। তবে তিনি তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শুধু ইউরোপ ও এশিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আবেদন করছেন। এই সেপ্টেম্বর মাসে শি কাজাখস্তানের নজরবায়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তব্যে তথাকথিত ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ শীর্ষক এক নতুন পররাষ্ট্রনীতির ঘোষণা দিয়েছেন। এর লক্ষ্য হচ্ছে, ইউরেশিয়াজুড়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও যৌথ উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এ প্রচেষ্টায় সফল হতে শি পাঁচটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন: অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোরদার, সড়ক যোগাযোগ উন্নতকরণ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মুদ্রা রূপান্তর সহজীকরণ, জনগণ-জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগ সংহতকরণ।
তার পরের মাসে শি ইন্দোনেশীয় পার্লামেন্টে এক বক্তব্যে বলেন, পুরোনো সমুদ্র নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেটার নামকরণ তিনি করেন একুশ শতকের ‘সমুদ্র সিল্ক রোড’; এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশগত গবেষণা ও মৎস্য শিকারের কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে। চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াং এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশনের সম্মেলন ও তারপর ইস্ট এশিয়া সামিটে তা পুনর্ব্যক্ত করেন। তখন থেকেই এই স্থল ও সমুদ্রপথের সিল্ক রোড প্রতিষ্ঠা চীনা সরকারের পররাষ্ট্রনীতির অংশে পরিণত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস তা অনুমোদন করেছে। শি জোর দিয়ে বলেছেন, এই সিল্ক রোডকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এই বিশ্বায়নের যুগে সেই পুরোনো সম্পর্কের নবায়ন হবে। কিন্তু নিঃসন্দেহে তাঁর মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ অভিপ্রায়ও রয়েছে। কারণ, পূর্ব ও পশ্চিম চীনের মধ্যে সম্পদের পার্থক্য ক্রমেই বাড়ছে।
চীনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম এর পূর্বাঞ্চলের শহর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও পরিবেশগত নানা রকম চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে অর্থনীতির যে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপ লাভ করা প্রয়োজন, সে লক্ষ্যে এসব ব্যাপার নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চীনা সরকার আশা করছে, এই সিল্ক রোড তৎপরতার মাধ্যমে চীনের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল আগামী দিনে দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। তথাপি এই উদ্যোগের আন্তর্জাতিক মাত্রাই এর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, আবার একই সঙ্গে তা জটিলও বটে। এর প্রভাব চূড়ান্তভাবে অনুভূত হওয়ার জন্য চীনা কূটনীতিকেরা কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁরা বলছেন, এ লক্ষ্যে কার্যসাধন-পদ্ধতি ও মঞ্চ গড়ে তোলা বা সেগুলো আরও সংহত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার করিডর, চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর, চঙকিঙ থেকে জার্মানি পর্যন্ত (পরে উত্তর ইউরোপীয় বন্দর পর্যন্ত) চীন নির্মিত ইয়ুক্সিনাও রেলওয়ে এবং চীন, কেন্দ্রীয় এশিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যে নতুন শুরু হওয়া জ্বালানি করিডর।
তদুপরি, চীন সমভাবাপন্ন কয়েকটি দেশ নিয়ে ব্রিকস নামক নতুন একটি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আবার চীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংক গঠন করেছে। চীনের হাতে বিনিয়োগ করার মতো প্রচুর অর্থ রয়েছে। ফলে এটিও খুব রমরমা হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। উভয় ক্ষেত্রে চীন প্রধান ভূমিকায় আছে, ফলে সিল্ক রোড-সংক্রান্ত উদ্যোগে অর্থায়নে কোনো সমস্যা হবে না। অর্থায়নে কোনো সমস্যা না হলেও চীন রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে পারে, বিশেষ করে সমুদ্রপথবিষয়ক সমস্যা চীনের মোকাবিলা করতে হতে পারে। যখন দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে চীনের দৃঢ়প্রত্যয়ী অবস্থান তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করছে, তখন এই সিল্ক রোড উদ্যোগ ভূরাজনৈতিক আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
বস্তুত এসব আশঙ্কার ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। ঝেঙের অভিযানে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। আজকের ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে সামরিক বল প্রয়োগ করে বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার ক্ষমতায় বসায় তারা ভারত মহসাগরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও ঝেং নিরাপত্তা পাহারা বসিয়েছিলেন। তিনি শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ার রাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন, এমনকি স্থানীয় শাসকদের অপহরণ করে তাঁদের হত্যাও করেছেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের দাঁতের পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন দখল করেছিলেন, এটা ছিল শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের নিদর্শন। ঝের সেই অভিযানের তোপে যে দেশগুলো পড়েছিল, তারা সেটা শুধু বাণিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে গণ্য করে না, বরং সেটাকে তারা নিজেদের দেশে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য করেছে। চীনা সম্রাটের নেতৃত্বে দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করার অজুহাতে এটা করা হয়েছে। এই দেশগুলোকে সেই বেদনার্ত অতীতের কথা মনে করিয়ে দেওয়াটা শুধু চীনের স্বার্থে করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
এটা বলছি না যে এই আধুনিক সিল্ক রোড শুধু চীনের উপকারে আসবে। এর বিপরীতে স্থল ও সমুদ্রপথের সমন্বয়ে গঠিত এই এই সিল্ক রোড তৎপরতায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলোতে চীনের বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আর চীনের হাতে বিনিয়োগ করার মতো প্রচুর টাকা আছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটা এক প্রাচীন চীনা ধারণার পুনঃপ্রবর্তনও করতে পারে, যেটা তিয়ানশিয়া নামে পরিচিত। এতে চীনা সম্রাট সারা দুনিয়া শাসনের জন্য ঐশ্বরিকভাবে নির্বাচিত বলে বিবেচনা করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ও আগে জাপান বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিজ নেতৃত্বে একটি ব্লক গড়ে তোলার চেষ্টার কথা নিশ্চয়ই অনেকের স্মরণে আছে। চীনও কি একই পথে হাঁটছে, একটু রাখঢাক করে?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.