মেধা বিকাশের সুযোগ কি আমরা পাব না? আবদুল্লাহ আল মামুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগামী বছর থেকে ভর্তি পরীক্ষার নতুন পদ্ধতি চালুর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার পক্ষে–বিপক্ষে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে কর্তৃপক্ষ আসন খালি থাকার দোহাই দিচ্ছে। আর শিক্ষার্থীদের একাংশ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করছে। সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে লিখেছেন শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মামুন
আমি গ্রামের একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর পাবনা শহরের একটি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। সেখান থেকে ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করার পর জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমি যখন এই চিঠি লিখছি, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা দ্বিতীয়বার কোনো শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেবে না। কলেজে ভর্তি হয়ে শহরে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বাড়ি থেকে সপ্তাহে দুদিন কলেজে যেতাম। প্রথম তিন মাস পর দেখি আর ক্লাস হয় না। সবাই শিক্ষকদের বাসায় প্রাইভেট পড়ে। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার হলো না। তাই বাধ্য হয়ে কলেজের আশা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে পড়াশোনা শুরু করলাম। তারপর সেখান থেকে প্রতিটি পরীক্ষা আমি কেন্দ্রে এসে দিয়ে চলে যেতাম এবং পরীক্ষার পর শুনতাম, এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দেখি, সবাই কোচিং করার জন্য শহরে আসছে। কিন্তু প্রথমেই সে সুযোগ আমার হয়নি। অনেক কষ্ট করে বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে রেজাল্টের ১৭ দিন আগে আমি পাবনার একটি কোচিংয়ে ভর্তি হই। সেখান থেকেই আমি প্রথম মেডিকেল, বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রদের সঙ্গে পরিচিত হই। তাঁদের মুখে নানা রকম গল্প শুনে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেখান থেকে ফরম পূরণ করে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসি পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি আমার করুণ অবস্থা। সবাই একাধিক জায়গায় কোচিং করেছেন। কেউ কেউ আবার মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়েছেন। সবাই ঢাকার স্বনামধন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। এবার পরীক্ষা দিচ্ছেন প্রায় ৮০ হাজার ছাত্রছাত্রী। এসব দেখে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশা দূর হয়ে গেল।
তারপর পরীক্ষা দিয়ে গ্রামে চলে আসি। এক সপ্তাহ পর রেজাল্ট। শুনলাম মাত্র ২১ হাজার ছাত্রছাত্রী পাস করেছেন। এর মধ্যে আমার ক্রমিক হয় নয় হাজার ৫৪৭, যা দুর্ভাগ্য, না সৌভাগ্য, বুঝতে পারলাম না। তবে আমার পক্ষে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া সম্ভব, তা পরিষ্কার হয়ে গেল। তারপর বাড়িতে এসে আমি আবার পড়াশোনা শুরু করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব বলে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম পূরণ করিনি। এবারে ক্রমিকে না টিকলে পরেরবার ভর্তি হতে পারব, এটাই প্রত্যাশা। তিন মাস ধরে আমি নিয়মিত পত্রিকা পড়ি, টিভিতে খবর শুনি। জীবনে বড় হওয়ার জন্য কী কী প্রয়োজন, তা কিছুটা বুঝতে শিখেছি। এসব বোঝার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর যেকোনো বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুইয়ে আসে। প্রায় রাতে আমি স্বপ্ন দেখি, আমি কার্জন হলে ক্লাস করছি, ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াচ্ছি। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে সিদ্ধান্ত নিল, সেটি জানার পর আমার মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কী হবে, তা তারা একবারও ভেবে দেখল না। কয়েক দিন আগে দেশ টিভির একটি টক শোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছিলেন, তাঁরা মেধাবী শিক্ষার্থী চান। তাঁরা যদি তা-ই চাইবেন, তাহলে একজন ছাত্র কোন বছর এইচএসসি পাস করছেন, তা বিবেচ্য হবে কেন। তিনি আরও বলেছেন, ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি বন্ধের জন্য পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নেবেন এবং নতুন ছাত্রছাত্রীদের জন্য অধিক সুযোগ করে দেবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় এত দিন যদি কোনো জালিয়াতি না হয়ে থাকে, তাহলে এখন হবে কেন। আজকে উপাচার্য মহোদয় আমাদের কথা চিন্তা করলেন না। অথচ তিনি গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন, তাঁদের অগ্রিম অভিনন্দন। যাঁরা পারবেন না, তাঁদের আরেকবার সুযোগ থাকবে।’
এই হতাশা আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থীর। আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। বড় হওয়ার জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করার ক্ষমতা নেই। আমাদের আছে সামান্য মেধা। এই মেধাটুকু বিকশিত করার সুযোগ কি আমরা পাব না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে তা অনেক আগে থেকেই নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
আবদুল্লাহ আল মামুন: শিক্ষার্থী।

No comments

Powered by Blogger.