ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব প্রাকৃতিক : এ পি জে আবদুল কালাম

বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বকে ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক হিসেবে উল্লেখ করে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ পি জে আবদুল কালাম বলেন, দেশ দুটোকে এগিয়ে যেতে হলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। ভারত ইতোমধ্যে তা করছে। বাংলাদেশকেও একই রকমের উন্নয়ন ভাবনার পরামর্শ দেন তিনি।  বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে  আবদুল কালাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) ১১০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এমসিসিআই প্রেসিডেন্ট রোকেয়া আফজাল রহমান এতে সভাপতিত্ব করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বক্তব্য রাখেন  বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল  আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক প্রাকৃতিক উল্লেখ করে আবদুল কালাম বলেন, এক দেশের সাথে আরেক দেশের মেলবন্ধন পুরনো।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল ইসলাম  দু’দেশেরই সম্পদ। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুও  অবিভক্ত ভারবর্ষের মুখোজ্জ্বল করেছেন।

ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে  মানুষকে এগিয়ে নেয়ার শক্তি জোগাচ্ছেন ড. মোহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, সাহিত্য-সঙ্গীতে আমাদের যেরকম মেলবন্ধন রয়েছে তেমনি সংস্কৃতিগত বন্ধনও দৃঢ়।  ‘ট্রাইবাল’রা ভারত ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য এনেছেন। তিনি বলেন, সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থান  করছে। এ  ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট দু’দেশেরই সম্পদ। আছে বঙ্গোপসাগর। দু’দেশের মানুষে মানুষে ভালোবাসাও অনেক পুরনো  বলে জানান আবদুল কালাম। বলেন, আমরা সব সময়ই একে অন্যের সহযোগী, বাংলাদেশের উন্নয়ন হোক; এটা আমার প্রত্যাশা। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে একের পর এক বন্ধ করে  দেয়া পাটকলই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা ও সম্ভাবনা জাগাতে পারে বলে  মনে করেন আবদুল কালাম। পাটশিল্প বিষয়ে একজন ব্যবসায়ী প্রশ্ন করলে উত্তরে কালাম বলেন, আপনার পরিকল্পনা কি?  পরিকল্পনা না থাকলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না; সম্ভাবনাও জাগানো যাবে না।
তিনি বলেন, পাটশিল্প বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য অপার সম্ভাবনাময় খাত। এ খাতকে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় অনেক দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব। সন্ত্রাস হটিয়ে শান্তি নিশ্চিতের বিষয়ে সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের প্রশ্নের জবাবে আবদুল কালাম বলেন,  অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারলে সন্ত্রাস  নিচে নেমে যাবে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করতে না পারলে সমাজে অসন্তোষ বাড়ে; বিশ্বজুড়ে অসন্তোষ পর্যালোচনা করলেও এটা  বোঝা যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অসন্তোষ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে  তিনি বলেন, আপনি জনগণের কাছে ফিরে যান; তাদের প্রত্যাশার সাথে নিজেকে মেলান। তাহলে এর সমাধান হয়ে যাবে। আপনি যদি ঠিক হয়ে যান, তাহলে জগতের সব ঠিক। তবে কিছু সমস্যা আছে যার সমাধান সময়সাপেক্ষ। এ জন্য তিনি ব্রিটিশ শাসনকে ‘দায়’ দিতে চান।
গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে সবাইকে ফেরানোর তাগিদ দিয়ে ভারতের এ সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনটি বিষয়ে সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রথমত, অবকাঠামোগত সংযোগ। এ সংযোগ বৃদ্ধিকে আমি সবার ওপরে রাখছি, কারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য বাস, রেল, হাসপাতাল ও শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে ুদ্রঋণ, মাঝারি শিল্পকে উৎসাহ দিতে হবে। তাহলে তারা এগিয়ে আসতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল সংযোগ। এর মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সুবিধা, টেলিমেডিসিন, বিদ্যুৎ সুবিধা এবং অন্যান্য জ্বালানি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মোবাইল সুবিধা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পেরেছে।  তৃতীয়ত,  জ্ঞান সংযোগ।  গ্রাম-উপশহরগুলোতে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এ শিক্ষা হবে এমন যা তার জীবনে কাজে লাগে। এ জন্য আমি বলে থাকি একজন লোকের মাস্টার্স পাস করার চেয়ে তার কর্ম সহযোগী একটা ডিপ্লোমার অনেক বেশি গুরুত্ব। চাকরিদাতাদেরও সেটি বিবেচনায় আনতে হবে।
আবদুল কালাম উদাহরণ টেনে বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন নিয়ে আমি যে কথা বললাম, সেটি আপনাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণও হতে পারে। চলুন আমরা একটা পরিকল্পনা দেখে নিতে পারি। খুলনাকে আমি সে জন্য নির্বাচিত করেছি। খুলনা অঞ্চলের মাছশিল্প ব্যাপক এগিয়েছে। এটা গ্রামীণ অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ করেছে। এর সাথে সেখানে পাট ও বাঁশশিল্পকে ঘিরেও অনগ্রসর মানুষ অগ্রসর হতে পারেন। সেখানকার স্থানীয় এ শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে পুরনো ধারণা থেকে বের হয়ে এর সাথে প্রযুক্তির সংযোগ ঘটাতে হবে। তাহলে বিশ্ববাজারে এর কদর বাড়বে।  খুলনা অঞ্চলে বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট রয়েছে। এটাকে নিয়ে সেখানে ইকো ট্যুরিজমের প্রসার ঘটানো সম্ভব। এ ধরনের  ব্যবসার জন্য উদ্যোক্তা দরকার; যারা  নতুন কিছু করবেন। 
ব্যবসায়ী কিংবা রাজনৈতিক নেতা সবারই ভিশন থাকতে হবে
আবদুল কালাম বলেন, আপনার একটা লক্ষ্য থাকতে হবে- আপনি ব্যবসায়িক নেতা হোন কিংবা রাজনৈতিক নেতা। সবার জন্যই এ কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আমার বিশ্লেষণে দেখেছি একজন নেতার সাফল্যের জন্য বেশ কয়েকটি গুণ থাকা খুবই জরুরি।
এক. আপনার ভিশন থাকতে হবে সংগঠনকে সংগঠিত করার। দুই. আপনার কর্মীদের মধ্যে ভিশন ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হতে হবে। তিন. আন এক্সপ্লোরড পথে নেতৃত্বের পথযাত্রা। চার. সফলতা ও ব্যর্থতাকে  ব্যবস্থাপনার মতো নেতৃত্ব। পাঁচ. সব ধরনের কাজে স্বচ্ছতা। ছয়.  সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা  এবং সাত. নৈতিকতা ও সততার সাথে সাফল্যের পথে যাত্রা।
আবদুল কালাম বলেন, একজন সফল ব্যবসায়ীর জন্য তার কর্মীরা বড় শক্তি ‘যদি সে কর্মী তার কাজের পরিবেশ পান, তার  কর্মস্থল হয় আনন্দময়’। তার ব্যবসায়িক নেতৃত্ব হয় সৃজনশীল, তাহলে সে প্রতিষ্ঠান এগোবেই। তিনি বলেন, যদি ব্যবসায়িক নেতা সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী হয়ে তার কর্মীদের সন্তোষজনক পরিবেশ নিশ্চিত করে, সততার সাথে ব্যবসায় পরিচালনা করে গ্রাহকের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে আস্থা আনতে পারেন তাহলে তিনি তো সফল হবেন।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ
বিজ্ঞানী আবদুল কালাম মনে করেন, বিশ্বের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।  যেগুলো উৎরে যেতে না পারলে সঙ্কট বাড়বে। এর মধ্যে তিনি সবার ওপরে রাখছেন দারিদ্র্যকে। আছে নিরাপত্তা, বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলাবায়ুর পরিবর্তন,  নিরাপদ খাবার পানি, গ্রিন এনার্জি নিশ্চিত করা, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং  সবার জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা ও মূল্যবোধের সুরক্ষা।  এ জন্য তিনি বিশ্বনেতাদের একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এটা কোনো একটি জাতির বা দেশের সমস্যা বা সঙ্কট নয়' সারা দুনিয়ার সঙ্কট।  এ সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। আবদুল কালাম বলেন, বিশেষ করে সার্ক অঞ্চলের মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে। এখানকার ২৫ শতাংশ মানুষ  বয়সে তরুণ।

No comments

Powered by Blogger.