বাংলাদেশের জাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ by ড. মাহফুজ পারভেজ

বাংলাদেশের জাতিসত্তাগত বিভেদের বিষয়টি ক্রমেই রাজনীতির মূল আলোচনার জায়গায় চলে আসছে। শাহবাগ বনাম শাপলার কিংবা বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তার দ্বন্দ্ব থেমে থেমে উস্কেও উঠছে। সর্বশেষে ড. পিয়াস করিমের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে তার মরদেহ নিয়ে যে উত্তেজনা দেখা দেয়, তাতে সবকিছু ছাপিয়ে আদর্শিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে হয়। কারণ জীবিত পিয়াস করিমের মতো তার মরদেহকেও গতিরুদ্ধ করা হয়েছে। যদিও ধর্মনিরপেক্ষ, উদার, গণতন্ত্রী পিয়াস করিম ও তার পরিবার জাতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল শহীদ মিনার হয়ে ধর্মীয় বিধানের স্থল বায়তুল মোকাররমে মরদেহ নিয়ে চেয়েছিলেন। কিন্তু শহীদ মিনারে বাধার দুর্গ গড়ে সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যমান দূরত্ব ও মতপার্থক্য সামান্য বা মিটিয়ে ফেলার মতো নয়। যদি হতো, তাহলে মৃত্যুর পর যখন সব দেনা-পাওনা শেষ হয়, তখনই সেটা হতো। হয়নি। বরং পিয়াস করিমের মরদেহের সঙ্গে জীবিত মানুষদের ব্র্যাকেট বন্দি করে একটি রাজনৈতিক, দার্শনিক ও আদশিক মেরুকরণের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিরই একটি পূর্বাভাস জানানো হয়েছে। আর ড. পিয়াম করিমের মরদেহ বাংলাদেশের জাতিসত্তা ও জাতিতত্ত্বের প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপ করে গেছে। শিগগিরই এসব বিষয়ে মীমাংসা হবে বলে মনে হয় না। বরং, এটা মনে করাই সঙ্গত, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তলে তলে আদর্শিক ও দার্শনিক লড়াইয়ের পথে চলে যাচ্ছে। আমরা জানি, একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, দর্শন, চিন্তা-ভাবনা এবং পরিচিতির একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকে। ইহুদি জাতির তত্ত্বগত দিকের সঙ্গে জার্মান জাতিসত্তার তত্ত্বগত দিক একেবারেই মিলবে না। বরং, একটি আরেকটিকে মারতে চায়। যেমন হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে। বাংলাদেশের জাতিতত্ত্বের প্রসঙ্গে বলা যায়, দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের পাক-ভারত-বাংলাদেশ ভিত্তিক উপমহাদেশের জাতিগত পরিচয় ও তাত্ত্বিক দিক বিকাশ লাভ করে ঔপনিবেশিক আমলে; ইউরোপীয় জ্ঞানকাণ্ডের সংস্পর্শে এসে। তখন জাতিগতভাবে সবাই ছিলেন বৃটিশ-ভারতীয় বা বৃটিশ-ইন্ডিয়ান। বিংশ শতকের শুরুতে বঙ্গভঙ্গ, বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯০৫-১৯১১) ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহে হিন্দু ধর্মভিত্তিক স্বাদেশিকতা তীব্র ও সশস্ত্র রূপ লাভ করে। প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় মুসলিম পরিচিতি। ১৯৪৭ সালে সে কারণেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়। পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার মানুষ বাঙালি পরিচিতির জন্য লড়াই করে এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে আর্থিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে লিপ্ত হন। এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক বিজয় সূচিত হয়। এ বাঙালিত্ব কিন্তু একেবারেই বাংলাদেশের সীমানা ও রাজনৈতিক চৌহদ্দিভিত্তিক। ভারতের বাঙালিদের এ জাতীয়তার তত্ত্ব আলোড়িত তো দূরে থাকুক, স্পর্শও করতে পারেনি। তারা বরং হিন্দুত্ব-বাঙালিত্ব-ভারতীয়ত্ব ভিত্তিক একটি ত্রিভুজ রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন। এটা করেছেন কলকাতা কেন্দ্রিক চিন্তা-দর্শন-জাতীয়তার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাঙালিত্ব রাজনৈতিক জাতীয়তায় বাংলাদেশীতে পর্যবসিত হয়েছে। আর এখন সে পরিচিতির মধ্যে প্রো-আওয়ামী বনাম অ্যান্টি আওয়ামী; কিংবা প্রো-সেক্যুলার বনাম অ্যান্টি-সেকুল্যার ইত্যাদি বিভাজন হয়েছে। দু’টি চিন্তা ও দর্শন কেন্দ্র তো স্পষ্ট- শাহবাগ আর শাপলা। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার ঘটেছে মাঝখানের নিরপেক্ষদের নিয়ে। শাহবাগের বিপক্ষে বা সমালোচনা বা ভিন্নমত দিলে সে শাপলার হেফাজতি। কিন্তু হেফাজতের বিরুদ্ধে বললেই শাহবাগী ব্লগার, নাস্তিক। এ চরম মেরুকরণ ও বিপরীতমুখীর মধ্যে জীবিত ড. পিয়াস করিম পড়েছিলেন। তিনি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সেসব আন্দোলনের ভালো-মন্দ দিক তুলে ধরে ছিলেন। তার ব্যক্তিগত মতের স্বাধীনতা গুরুত্ব ও সম্মান পায়নি। তার কোন বক্তব্য সম্পর্কে শাহবাগের কোন ভিন্নমত ও ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি। তাকে ঠেলে বিপক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হলো। যদিও তিনি শাপলার হেফাজতিদেরও অনেক সমালোচনা করেছেন। কিংবা বিশেষ কয়েকটি পক্ষ মৃত্যুর পরেও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। অনেক সাংবাদিক-সম্পাদক, যারা টক শোতে মত দেন, ভিন্নমত দেন, তাদেরও এক কাতারভুক্ত করা হয়েছে। যারা উপস্থাপক হিসেবে আলোচকদের মত শোনা ছাড়া নিজের কোনো মতামত দেন না, তাদেরও প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছে, যার মধ্যে এমন একজন আছেন, যিনি স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, বৃহত্তর সিলেটের একটি বিখ্যাত কলেজ সংসদের নির্বাচিত নেতা (ছাত্রলীগের প্রার্থীরূপে), বাম প্রগতিশীল পত্রিকা ‘সংবাদ’ ও স্বাধীনতা তথা আওয়ামী লীগ বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুখপত্র ‘ইত্তেফাক’-এর সাবেক সাংবাদিক, বাক-স্বাধীনতার জন্য স্বৈরশাসনামলে আক্রান্ত, নিগৃহীত ও কারা নির্যাতিত এবং এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত একজন নিরপেক্ষ সম্পাদক। ফলে মেরুকরণ কেবল আদর্শের নামেই হচ্ছে না; অজ্ঞতা ও উগ্রতার ভিত্তিতেও হচ্ছে। একেবারেই হিংসার বশবর্তী বা শত্রুতার কারণেও করা হচ্ছে। মহল বিশেষের এসব উৎকেন্দ্রিকতা বাংলাদেশের জাতিতত্ত্ব ও জাতিসত্তাকে কোন বিপদে ফেলে দেয়, কে জানে? মনে হয়, গোপনে কারা যেন আমাদের চারপাশে হিংসা আর ধ্বংসের বীজ বপন করছে। নইলে এমন লোকদেরও আক্রমণ করা হচ্ছে কেন, যারা বাক-ব্যক্তি-গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরীক্ষিত বন্ধু? 

No comments

Powered by Blogger.