থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বাংলাদেশী ‘ক্রীতদাস’ -বিক্রির উদ্দেশে পাচার

‘ক্রীতদাস’ হিসেবে বিক্রির উদ্দেশে পাচারের শিকার হয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী। তাদেরকে ভাল বেতনের প্রলোভন দিয়ে জোর করে নৌকায় তুলে নেয়া হয়েছিল। এরপর থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নিয়ে যায় পাচারকারীরা। তিন সপ্তাহ আটকে রাখা হয় গহিন সেই জঙ্গলে। ঠিকমতো খাবার দেয়া হয়নি তাদের। অনাহারে তাদের অবস্থা শোচনীয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরকে দিনে মাত্র একবার খাবার দেয়া হয়। মারধর করা হয়। জঙ্গলের ভিতর তারা এখন বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। বিবিসির এক ভিডিওতে দেখা গেছে, তারা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছেন। তাদের অনেকে মারাত্মক অসুস্থ। হাঁটার শক্তি হারিয়েছেন অনেকে। দেশে স্বজন, প্রিয়জনদের কাছে ফিরে আসতে চান তারা। এ অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার করেছে কর্তৃপক্ষ। এই হলো অবস্থা ‘ক্রীতদাস’ হিসেবে বিক্রি করে দেয়ার জন্য পাচার করা বাংলাদেশীদের। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয় প্রায় ১৭০ অবৈধ অভিবাসীকে। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশী। বাকিরা মিয়ানমারের নাগরিক। বিবিসি আভাস দিয়েছে, উদ্ধার করা এ সব ব্যক্তিকে এখন অবৈধ দেখিয়ে থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ জেলে পাঠাতে চাইছে। তবে এ নিয়ে মতবিরোধ শুরু হয়েছে সরকারের মধ্যে। থাইল্যান্ডের স্থানীয় কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা সেখানকার জঙ্গলে দাস বেচাকেনা করছে। এদেরকে সেই উদ্দেশ্যেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারা এই পাচার চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। বিবিসির সংবাদদাতা জোনাথান হেড বলেন, স্থানীয় কর্মকর্তারা যা-ই বলুন, থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিকে দেখছে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। যারা এই পাচারকারী চক্রের হোতা, তাদের অনেকেই প্রভাবশালী এবং উচ্চপর্যায়ে তাদের ভাল যোগাযোগ আছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে পুলিশের মধ্যে অনীহা আছে। অতীতে এ ধরনের পাচার চক্রের শিকার হয়েছিলেন যারা, তাদের উদ্ধারের পর অবৈধ অভিবাসী হিসেবে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এদের আবার পাচারকারীদের কাছেই বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। গত ১১ই অক্টোবর ১৭০ অভিবাসীকে উদ্ধারের পর ১৪ই অক্টোবর মানবপাচার ও বিক্রির দায়ে অভিযুক্ত ২ থাই নাগরিককে আটক করেছে পুলিশ। যদি তারা অভিযুক্ত হয় আদালতে তাহলে তাদেরকে ১০ বছরের জেল দেয়া হতে পারে। তবে তাদের মূল হোতা কে তা খুঁজে পেতে চেষ্টা করছে পুলিশ। ওদিকে থাইল্যান্ডের একটি স্থানীয় পত্রিকা লিখেছে, পাচার করা ওইসব অভিবাসীর মধ্যে রয়েছেন বয়স্ক লোক, যুবক। তাদেরকে জোর করে তুলে নেয়া হয়েছিল মাছধরা ট্রলারে। এরপর তাদেরকে ফুকেতের উত্তরাঞ্চলীয় একটি দ্বীপে লুকিয়ে রাখা হয়। ফলে পাচার বন্ধে থাইল্যান্ডের সামরিক সরকারের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তাকুয়াপা কমিনিউনিটি হলে ক্রিস্টান, মুসলিম ও বৌদ্ধ সমাজসেবকদের সঙ্গে সাক্ষাতৎকারে ওই অভিবাসীরা জানিয়েছেন তাদেরকে অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ জনের বেশি একটি তালিকায় তাদের নাম ও দেশে স্বজনদের টেলিফোন নম্বর দিয়েছে। সেই তালিকা ব্যাংককে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে পাটিয়ে দিয়েছে ফুকেট কর্তৃপক্ষ। এই তালিকা দূতাবাসের কাছে পৌঁছে দেয়ার কারণ হলো, যাতে তারা ওই সব অভিবাসী বেঁচে আছেন এ খবরটি তার স্বজনদের জানাতে পারেন। এতে বলা হয়, দূতাবাস থেকে ওই তালিকার প্রথম দুটি নামের ব্যক্তির আত্মীয়দের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা হয়েছে। তারা বলেছেন, তাদের স্বজন স্বেচ্ছায় কাজের উদ্দেশে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছিল। নতুন করে তারা আরও অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলার জন্য থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষা করছে। ওদিকে ইকুয়াল রাইটস ট্রাস্ট তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে বোটে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৩০০০ মানুষ পাড়ি দিয়েছে সমুদ্রপথে। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে এ রকম অভিবাসীর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। তখন এ সংখ্যা ছিল ৬ হাজার। অনেক ক্ষেত্রে অভিবাসীদের বহনকারী নৌকার ইঞ্জিন খুলে নেয়া হয়েছে। এর যাত্রীদের শুধু সামান্য খাবার ও পানীয় দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার কড়া নিন্দা জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এভাবে বিদেশে পাড়ি জমায়।

বিবিসি জানায়, উদ্ধারকৃতদের একজন যশোরের মোহাম্মদ বিল্লাহ হোসেন। তারা এত দিন কোথায় ছিলেন তা জানতো না তার পরিবার। বন্ধুদের সঙ্গে টেকনাফে বেড়াতে যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন বিল্লাহ। এরপর থেকে তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না পরিবারের। বিল্লাহর পিতা বলেছেন, সে আমাকে একটা কথা বলল যে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- কয় দিন হবে? জবাবে বিল্লাহর পিতা বলেন, ধরুন ৮-১০ দিন হবে আর কি। থাইল্যান্ড থেকে জেলখানায় এক লোক গিয়ে দেখে আসে। এর পরে আর কোন যোগাযোগ নেই। দালালে বলল, ও থাইল্যান্ডে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এরপর থেকে আমরা কয় দিন ধরে যোগাযোগ করছি। কিন্তু তার কোন খোঁজ পাচ্ছিলাম না। সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়ায় বাড়ি উদ্ধারকৃত নূর আলীর। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। গত মাসে দালালদের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। তার ছেলে গোলাম রসুল বলেন, থাইল্যান্ড পৌঁছে তারা পিতা একবার ফোন করেছিলেন। তখন তিনি পরিবারকে জানিয়েছিলেন দালালেরা তাকে থাইল্যান্ডে নিয়ে গেছে। গোলাম রসুল বলেন, তারা পিতা মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিলেন ১৮ তারিখে। যাচ্ছিলেন কক্সবাজারের মামুনের মাধ্যমে। সাতক্ষীরার মাধ্যম হচ্ছে মোহাম্মদ আকরাম। তারা আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে প্রথমবার আড়াই লাখ। ওখানে গিয়ে আরও টাকা দিতে হবে এক লাখ। মালয়েশিয়ায় বিমান দিয়ে নিয়ে যাবে, এরপর সেখানে ভাল ফার্নিচারের কাজ দেবে। এ বলে তাকে ভুলভাল বুঝিয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু থাইল্যান্ডে নদীপথ দিয়ে নিয়ে যায়। বিবিসি’র দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা জানিয়েছেন, তারা থাইল্যান্ডে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বন্দি থাকার পর, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। এখন উদ্ধারকৃত এ ১৮১ জন বাংলাদেশীকে তাকুয়াফা নামক একটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশীরা সবাই দেশে ফেরত আসতে চান। তবে এ বাংলাদেশীদের নিয়ে থাই সরকার এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। থাইল্যান্ডে মানবপাচারের বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল। তখন পরবর্তীকাল থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল থাই সরকার। তাই এখন এ ১৮১ বাংলাদেশীকে মানবপাচারের শিকার বলে স্বীকার করতে চাইছে না তারা। কয়েকজন ঊর্ধ্বতন থাই কর্মকর্তা বলেছেন, এদের মানবপাচারের শিকার হিসেবে স্বীকার না করলে এদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ধরতে হবে। সেক্ষেত্রে এদের জেল জরিমানাও হয়ে যেতে পারে।

এদিকে এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বিবিসিকে বলেন, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের থাই দূতাবাসের মাধ্যমে সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। থাই সরকার আমাদের জানিয়েছে, উদ্ধারকৃতদের থাংরা রাজ্যে রাখা হয়েছে। তারা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে ১২২ জন বাংলাদেশী ও বাকিরা মিয়ানমারের নাগরিক হতে পারে, যাদের আমরা সচরাচর রোহিঙ্গা বলে থাকি। এর আগেও আমরা একাধিকবার এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি। আমরা এটিকে বলি মানবপাচার। একটি রেকর্ড আছে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে একটি চক্র বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের নাগরিকদের থাইল্যান্ডে বা মালয়েশিয়ায় পাচার করে থাকে। এ ধরনের বিষয়েরই অবতারণা হয়েছে এখানে।
এখন বাংলাদেশের করণীয় কি হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়মে যা আছে, আমরা কনস্যুলার সুবিধা চাইবো। যে কোন মুহূর্তে এ ব্যাপারে অনুমতি পেলে আমরা ওখানে গিয়ে উদ্ধারকৃতদের জাতীয়তা নিরূপণের চেষ্টা করব। তারপর অবশ্যই তারা বাংলাদেশী হলে আমরা তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবো।
বিবিসি’র সংবাদ অনুযায়ী তাদের থাই সরকার অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে বিচার করতে চাইছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকভাবে কিছু প্রক্রিয়া আছে। সেটি হচ্ছে কনস্যুলার অ্যাক্সেস চাওয়া হয়, এরপর জাতীয়তা নিরূপণ করে আটককৃতদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়া হবে, তবে অবশ্যই যদি তারা বাংলাদেশী নাগরিক হয় ও বাংলাদেশে ফিরে আসতে চায়।

No comments

Powered by Blogger.