চট্টগ্রাম বন্দর: আমদানি পণ্য খালাস করতেই ১১ দিন ৯ ঘণ্টা -এনবিআরের সমীক্ষা by জাহাঙ্গীর শাহ

চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্য খালাস করতে গড়ে ১১ দিন ৯ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট সময় লাগে। আর রপ্তানি প্রক্রিয়ায় জাহাজীকরণে সময় লাগে ৪ দিন ২২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট। আমদানির ক্ষেত্রে জাহাজ বন্দরে ভেড়ার পর মালামাল নামানো ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাতে এবং রপ্তানির কোনো চালান বন্দরে পৌঁছার পর আনুষঙ্গিকতা শেষে তা জাহাজে ওঠাতে এই সময় ব্যয় হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমীক্ষায় এ তথ্য বের হয়ে এসেছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা বলছে, বন্দরে মালামাল খালাস ও জাহাজীকরণ সময় এবং অবকাঠামোর সুবিধায় বিশ্বের মধ্যে ১০৮তম হলো বাংলাদেশ। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশ করা ১৬০টি দেশের বন্দর-সুবিধার ক্রমতালিকা বা র্যাং কিংয়ে বাংলাদেশের এই অবস্থান উঠে এসেছে। এনবিআরের শুল্ক বিভাগের সমীক্ষায় বন্দরের পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণে সময়সীমা কমিয়ে আনতে একটি সময়সীমাভিত্তিক পরিকল্পনা করারও সুপারিশ করা হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বাজেট সহায়তার অর্থের মধ্যে সমীক্ষার শর্তটি ছিল। গত জুন মাসে সমীক্ষাটি প্রকাশ করা হয়।

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজ থেকে নামার পর পণ্য খালাস পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই বেশি সময় লাগছে। এতে ব্যবসায় ব্যয় বাড়ে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অফ ডকে চার দিনের মধ্যে পণ্য খালাস করার কথা। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে বেশি সময় লাগে। এ জন্য দৈনিক প্রতি কনটেইনারে (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের) ছয় হাজার ২০০ টাকা মাশুল দিতে হচ্ছে। এ কারণে ব্যয় অনেক বাড়ছে।’ এসব বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ঘাড়েই চাপে। পণ্যের দাম বেড়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য খালাসের এ সময়সীমা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্বের বড় বড় বন্দরের চেয়ে সাড়ে পাঁচ গুণের বেশি সময় লাগে চট্টগ্রাম বন্দরে।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশন (ডব্লিউসিও) বিশ্বের বড় ২৩টি সমুদ্রবন্দরের পণ্য খালাসের সময়সীমার ওপর সমীক্ষা করে। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন আমদানিকারককে যে ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়, সেই একই ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে অন্য দেশে বন্দরের পণ্য খালাস করতে মাত্র ৬২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট বা ২ দিন ১৪ ঘণ্টা ২৪ মিনিট সময় লাগে। সাধারণত নন-অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) প্রতিষ্ঠান এভাবে পণ্য খালাস করে থাকে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এইও প্রতিষ্ঠান নেই। এমনকি এইও প্রতিষ্ঠানকে অনলাইন শুল্ক পরিশোধ, গ্রিন চ্যানেলে পণ্য খালাসের মতো সেবা দেওয়ার মতো অবকাঠামোও নেই চট্টগ্রাম বন্দরে। ডব্লিউসিওর একই সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটরের ক্ষেত্রে পণ্য খালাসে সময় লাগে মাত্র ৩৮ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট বা ১ দিন ১২ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের ৯০তম বৃহত্তম বন্দর। এই বন্দর দিয়ে বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের প্রায় ৫০ শতাংশই আসে। আর রপ্তানি পণ্যের ৮০ শতাংশ পরিমাণই যায় এ বন্দর দিয়ে। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে বছরে যে পরিমাণ শুল্ক-কর আদায় করে, এর ৪০ শতাংশই আসে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস করতে তুলনামূলক অনেক বেশি সময় লাগে—এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। ব্যবসায়ীরাও এই অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন। তাঁরা বলছেন, পণ্য খালাসে সময় বেশি ব্যয় হয়। এতে ইয়ার্ডে পণ্য ফেলে রাখতে হয়। আমদানিকারককে মাশুল গুনতে হয়। ফলে পণ্য আমদানিতে ব্যয় বাড়ে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ঘাড়েই চাপে।
মূলত জাহাজ থেকে পণ্য নামার পর শুল্কায়ন পর্যন্ত রাখা, শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন এবং পণ্য খালাস—এই তিনটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কী পরিমাণ সময় লাগে, সেটাই এনবিআরের শুল্ক বিভাগের সমীক্ষায় উঠে এসেছে। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত এই সমীক্ষায় মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ২১ হাজার ৫৭৩টি বিল অব এক্সপোর্ট এবং ১৪ হাজার ৭৩২টি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে এই সমীক্ষা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার মাসুদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উন্নয়নে অন্যতম প্রধান শর্ত হলো বন্দর-সুবিধা। প্রতিযোগী দেশগুলো এ ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই সমীক্ষাটির মাধ্যমে বাংলাদেশের বৃহত্তম বন্দরের বাস্তব অবস্থা কী—সেটা জানা গেল। এখন বন্দর-সুবিধা বাড়ানো গেলে ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময় ও সাশ্রয়ী খরচে পণ্য খালাস করতে পারবেন। তবে এই সমীক্ষায় যে সময়সীমার কথা বলা হয়েছে—এর সঙ্গে একমত নন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ। তিনি মনে করেন, বাস্তবে আরও বেশি সময় লাগে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার সময় আমদানিকারকের ঘোষণা দেওয়া পণ্যের এইচএস কোড, ইনভয়েস ইত্যাদি মানতে চান না শুল্ক কর্মকর্তারা। ফলে দুই পক্ষের সমঝোতা হতে সময় লাগে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, হংকং বন্দরের মতো ভারী যন্ত্রপাতি বা আমদানি পণ্য নামানোর মতো আধুনিক সুবিধা নেই চট্টগ্রাম বন্দরে। এতেও সময় নষ্ট হয়।
মনজুর আহমেদের সুপারিশ, সময় কমাতে আমদানি-রপ্তানি পণ্য খালাস বা জাহাজীকরণে সিঙ্গেল উইন্ডো বা একক কাউন্টারেই সব সুবিধার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত শুল্ক বিভাগ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআইসহ সব পক্ষ এক জায়গায় কাজ করবে। আমদানি বা রপ্তানিকারককে পৃথক পৃথক কাউন্টারে গিয়ে এসব ঝামেলা মেটাতে যেন না হয়।
কোথায় কত সময় লাগে: সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোনো কোনো আমদানি পণ্যের জাহাজ ভেড়ার পর জেটিতে কার্গো খালাসের আনুষঙ্গিকতা সম্পন্ন করতে ১২ দিন ১১ ঘণ্টা ২২ মিনিটও লেগে গেছে। আবার অফ ডকে কার্গো প্রক্রিয়ায়ও লেগেছে ৪ দিন ১০ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। এরপর কাস্টম হাউসে শুল্কায়ন সম্পন্ন হয় ৫ দিন ১০ ঘণ্টা ১৩ মিনিটে। আর শুল্কায়ন শেষ হলে পণ্য বন্দর থেকে বের করতে আরও ২ দিন ১০ ঘণ্টা ৪ মিনিট লাগে। আর পণ্য বের হওয়ার সময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তা যাচাই করতে সময় নেয় ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে এর চেয়ে সময় কিছু কম লাগে। যার কারণে সব মিলিয়ে আমদানিকৃত এক চালান পণ্য খালাসে গড়ে সময় লাগে ১১ দিন ৯ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট।
অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যের চালান বন্দরে পৌঁছার পর তুলনামূলক কিছুটা দ্রুততর সময়ে জাহাজে ওঠে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে লাগে গড়ে ৪ দিন ২২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট। পণ্যের চালান পৌঁছার পর বন্দরে প্রবেশ, কাগজপত্র জমা, ইয়ার্ডে পৌঁছানোসহ আনুষঙ্গিকতা শেষ করতেই ৩ দিন ১৭ ঘণ্টা ৫০ মিনিট লেগে যায়। আর ঘোষণা অনুযায়ী চালানটি যাচাই-বাছাই করাসহ শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষ হয় ৫ ঘণ্টা ৩৭ মিনিটে। তবে শুল্কায়ন শেষ করার পর বন্দর কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র নিয়ে জাহাজে তা ওঠাতে সময় লাগে ১ দিন ১৯ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট।
বাংলাদেশ ১০৮তম: সমুদ্র ও স্থল—এই ধরনের বন্দর-সুবিধায় বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে। অথচ বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বন্দর-সুবিধা বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিশ্বব্যাংক প্রতিবছর বন্দর-সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন দেশের ক্রমতালিকা প্রকাশ করে। শুল্কায়ন, অবকাঠামো, আন্তর্জাতিক জাহাজীকরণ, বিভিন্ন পর্যায়ে আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সুবিধা, পণ্য খালাসে সময়সীমা—এসব সূচকের মাধ্যমে এই তালিকা করা হয়।
২০১৪ সালের সেই সূচকে দেখা গেছে, ১৬০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৮। সব সুবিধা বিবেচনায় প্রথম স্থানে রয়েছে জার্মানি। এর পরের দুটি স্থানে যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়াম। সোমালিয়ার বন্দর-সুবিধা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে শুধু ভুটান ও আফগানিস্তান। আর সবচেয়ে কম সময় লাগে ভারতে। বিশব্যাপী ক্রমতালিকাতে অবশ্য ভারতের অবস্থান ৫৪তম। ক্রমতালিকাতে পাকিস্তান ৭২, মালদ্বীপ ৮২, শ্রীলঙ্কা ৮৯, নেপাল ১০৫, ভুটান ১৪৩ এবং আফগানিস্তান ১৫৮তম স্থানে রয়েছে। এশিয়ার মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে জাপান। দেশটির বিশ্ব ক্রমতালিকায় অবস্থান ১০তম।

1 comment:

  1. ধন্যবাদ, অনেক কিছু জানার ছিল। আমরা অনেকে অনেক কিছুই জানি না। আপনা এই পোস্টটি দ্বারা অনেকে কিছু তথ্য জানতে পারবে।আমি আপনাকে কোন প্রকার অফার করছি না। ছোট একটি তথ্য আপনার উপকারে আসতে পারে Office Space rental

    ReplyDelete

Powered by Blogger.