বিক্রি হওয়া এক বালিকার কাহিনী

ইরাকের ইয়াজিদি সমপ্রদায়ের এক বালিকা বর্ণনা দিলো নিজের পরিবার থেকে কিভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করে সিরিয়াতে দাসী হিসেবে বিক্রি করেছে আইএস জঙ্গিরা। ১৫ বছর বয়সী এ তরুণী এখন তার পরিবারের সঙ্গে আছে। অবশ্য তার পরিবার বলতে এখন কেবল দুই ভাই আর কিছু দূরসম্পর্কের আত্মীয়। বর্তমানে ইরাকের উত্তরে এক ছোট গ্রামে রাস্তার পাশে তাদের বসবাস। আইএস জঙ্গিদের হাতে নির্যাতিত আরও পরিবার তাদের মতো আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। নিজে ভাগ্যের জোরে ফিরে আসতে পারলেও, তার দুই বোন এখনও রয়ে গেছে জঙ্গিদের হাতে। তার পিতা, অন্য ভাইরা এবং পুরুষ আত্মীয়রা নিখোঁজ। তারা বেঁচে আছেন, নাকি মরে গেছেন, সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। আগস্টের শুরুতে তার মতো শ’ শ’ নারী ও মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় আইএস জঙ্গিরা। সে সময় তাদের নিজেদের শহর সিনজারে হামলা চালিয়েছিল আইএস। তখন শ’ শ’ মানুষ প্রাণ হারান। হাজারো মানুষ হারায় বসতভিটা। ইরাকের মানবাধিকার মন্ত্রণালয় বলেছে, জঙ্গিরা হাজার নারীকে তুলে নিয়ে গেছে। ১৫ বছর বয়সী ওই বালিকাসহ আইএস-এর আস্তানা থেকে পালিয়ে আসা অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে বার্তা সংস্থা এপি। তবে তাদের দেয়া বক্তব্য নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবুও তাদের কথাগুলো গত মাসে জাতিসংঘের দেয়া প্রতিবেদনের প্রতিফলন ঘটায়। তারা সবাই পৃথকভাবে সিরিয়া ও ইরাকে আইএস-এর বিদেশী সদস্যদের কাছে বিক্রি কিংবা অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ‘বিয়ে’ করানোর যে বর্ণনা দিলেন তা প্রায় একই। সিনজার থেকে তাদের অপহরণের কয়েক সপ্তাহ পর, ১৫ বছর বয়সী ওই বালিকা ও তার আরও দুই বোনকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা হয়। তবে এপি নির্যাতনের শিকার এসব নারীদের পরিচয় সনাক্ত করেনি। তাছাড়া যেহেতু তাদের আত্মীয়স্বজন অনেকে এখনও আইএস-এর হাতে রয়ে গেছে, তাই ভয়ে নিজেদের নামও প্রকাশ করতে চায় না তারা। নিজের করুণ গল্প বলার সময় মেয়েটিকে দেখা গেছে নিজের দু’টি হাত শক্ত করে ধরতে। চোখের দিকে না তাকিয়েই পরিষ্কার ভাষায় বলে যায় সব কিছু। এমনকি প্রশ্নের মুখেও থামে না বলা। প্রথমে নিজের আত্মীয়দের কক্ষ থেকে বের হতে বলার পর জানালো, এখানে একমাত্র সেই অস্বস্তি এড়িয়ে ভালভাবে বলতে পারবে। এরপর সে জানালো, তাল আফার শহরের কাছ থেকে তাকে ও অন্য মেয়েদের অপহরণ করা হয়। এরপর বাদোশ জেলখানায় রাখা হয় তাদের। সে শহরে যখন মার্কিন বিমান হামলা শুরু হয়, তখন তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আইএস জঙ্গিদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি মসুলে। মসুল থেকে তাকে ও তার বোনদের নিয়ে যাওয়া হয় আইএস জঙ্গিদের মূল আস্তানা সিরিয়ান শহর রাকা’তে। সেখানে তাদের আরও অনেক অপহৃত মেয়েদের সঙ্গে একটি ঘরে রাখা হয়। তার ভাষায়, তারা মেয়েদের সিরিয়া নিয়ে যাওয়া হয় বিক্রি করতে। আমাকে সিরিয়ায় বিক্রি করে দেয়া হলো। আমি প্রায় ৫ দিন ছিলাম আমার দুই বোনের সঙ্গে। এরপর আমার এক বোনকে বিক্রি করে দেয়া হলো এবং মসুলে ফেরত নিয়ে যাওয়া হলো। আমি সিরিয়াতেই রয়ে গেলাম। রাকাতে তাকে প্রথম বিয়ে দেয়া হয় এক ফিলিস্তিনি পুরুষের সঙ্গে। মেয়েটির দাবি এ পুরুষকে সে গুলি করেছিল! ফিলিস্তিনি ব্যক্তিটির ইরাকি এক গৃহকর্মী ছিল। সে ব্যক্তিই মেয়েটিকে একটি গুলি দিয়ে সাহায্য করে। সে এরপর পালিয়ে যায়, কিন্তু তার আসলে কোথাও যাওয়ার ছিল না। তাই তার জানা মতে একমাত্র জায়গাটিতেই গেল সে। সেটি হচ্ছে রাকাতে তাকে অন্য অনেক মেয়ের সঙ্গে রাখা ঘরটিতে। কিন্তু সেখানে জঙ্গিরা তাকে দেখে চিনতে পারেনি এবং তাকে আবারও বিক্রি করে দেয় ১ হাজার ডলারের বিনিময়ে। সে লোকটি তাকে এমন এক ঘরে নিয়ে যায় যেখানে তার সঙ্গে অন্য অনেক যোদ্ধাও ছিল। তার ভাষায়, সে লোকটি আমাকে বলে, আমি তোমার নাম পরিবর্তন করে আবির রাখতে যাচ্ছি। তাই তোমার মা তোমাকে চিনতে পারবে না। আমি তোমাকে বিয়ে করবো। সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। মেয়েটি আরও জানায়, ওই সময় যোদ্ধাদের এক ধরনের নেশাজাত পাউডার গ্রহণ করতে দেখেছে সে। ওই নেশাজাত পাউডার চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে সে ব্যক্তি ও অন্য যোদ্ধাদের পান করায় সে। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর পালায় সে। এরপর সে এক ব্যক্তিকে খুঁজে পায়, যে তার ভাইয়ের কাছে যাচ্ছিল তুরস্কে। তার ভাই এক ব্যক্তির কাছে ২ হাজার ডলার ধার নিয়ে এক স্মাগলারের মাধ্যমে তাদেরকে ইরাকে পাঠায়। এরপর তারা কুর্দি শহর ডাহুকের পাশে মকলুবাতে থামে। এখানে আগে থেকেই বহু ইয়াজিদি অবস্থান করছিল। এছাড়া অন্য অনেক মহিলাও বর্ণনা করেছে নিজেদের সে সময়কার কঠিন দিনগুলোর কথা। জঙ্গিরা তাদের আটক করার পর খাদ্য, পানি এমনকি বসার জায়গা পর্যন্ত ঠিকমতো দিত না। তাদের সবাই বলেছে, জঙ্গিদের আস্তানায় বহু ইয়াজিদি নারীকে দেখেছে। তাদের সঙ্গে ছিল ৫ বছর বয়সী শিশুও। তাদের কোন না কোন আত্মীয় এখনও আটক আছে আইএস জঙ্গিদের হাতে। ১৯ বছর বয়সী আমশা আলিকে সিনজার থেকে মসুলে নেয়া হয়েছিল। সেসময় আমশা ছিল ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি নিজের স্বামী ও অন্য পুরুষ আত্মীয়দের শেষবারের মতো দেখেছিলেন যখন তাদের মেরে ফেলার জন্য মাটিতে শোয়ানো হয়েছিল। তিনি বলেন, মসুলে তিনি সহ অন্য নারীদের একটি ঘরে জঙ্গিদের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য নেয়া হয়েছিল। প্রত্যেক জঙ্গি একেকজন নারীকে বেছে নিল। তাকেও এক যোদ্ধার সঙ্গে বিয়ে দেয়া হলো। তবে তাকে ধর্ষণ করা হয়নি। বোধ হয় গর্ভাবস্থার কারণেই। কিন্তু অন্য মেয়েদের ধর্ষণ করার ঘটনা তিনি দেখেছেন। কয়েক সপ্তাহ পর, তিনি বাথরুমের জানালা দিয়ে পালাতে সক্ষম হন। মসুলের এক ব্যক্তি তাকে রাস্তায় খুঁজে পেয়ে এ শহর ছেড়ে কুর্দি এলাকায় পালাতে সাহায্য করে। তিনি বলেন, আমি অন্য নারীদের পালানোর জন্য বোঝাচ্ছিলাম। কিন্তু তারা ছিল খুবই ভীত। তারা সেখানেই রয়ে গেল। তাই তাদের ব্যাপারে আমি আর কিছুই জানি না। এখন তিনি পিতার কাছে রয়েছেন। এক অর্ধনির্মিত ভবনে তারা থাকেন। সেখানে এরকম ৫ হাজার ইয়াজিদি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, মেরে ফেলাটা আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন জিনিস ছিল না। এমনকি তারা আমার স্বামী, দেবর, শ্বশুরকে মারার জন্য মাটিতে শুইয়ে রেখেছিল। এ দেখাটা সত্যিই বেদনাদায়ক। কিন্তু সে জঙ্গিদের জোর করে বিয়ে করাটা আরও কঠিন। সেটাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন।

No comments

Powered by Blogger.