আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ by মিজানুর রহমান খান

আসুন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে গলা মেলাই: ‘হাসপাতালের সামনে পশুর হাট বসানোর দায়ে প্রশাসকের অপসারণ চাই।’ যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে নাসিমের নিজের কথায়, ‘আমার দল সিদ্ধান্ত নেবে’, কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আমরা এখনই জানতে চাই। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ তথা আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ সংঘাত করে গত সাড়ে তিন বছরে (জুন পর্যন্ত) অন্তত ১০০ নিহত হয়েছে (সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র)। কেন ক্ষমতাসীন দলটি নিজেরা নিজেদের মধ্যে এই খুনোখুনির ঘটনা ঘটাল, তা খতিয়ে দেখতে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন চাই। জামায়াত ও তার মিত্র বিএনপির রাজপথের সন্ত্রাস এবং জঙ্গিত্ব এতটাই বেশি প্রচার পেয়েছে যে আওয়ামী লীগের খুনোখুনি আড়ালে পড়ে গেছে। আর আওয়ামী লীগের শান্তিবাদী নেতারা অভাবনীয় রক্তক্ষরণের শিকার হচ্ছেন। নাসিমের দুটি দাবিই বাস্তবায়নের পরিবেশ বাংলাদেশে নেই। আমি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করে আজ স্পন্দিত। ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘সত্তরের অবিস্মরণীয় বিজয়ের পরেই তাজউদ্দীন ভাইয়ের নির্দেশনায় খসড়া সংবিধান লিখতে বসি। তখন তিনি পুনর্ব্যক্ত করলেন যে সাংবিধানিক লক্ষ্য ও সংকল্প অর্জিত হতে পারে, কেবল যদি দলকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত করা সম্ভব হয়, যদি একটি স্পন্দমান ও স্বাস্থ্যকর রাজনীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তরুণদের দলে নিয়োগ করা যায়।’ (বাংলাদেশ কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস, ইউপিএল, পৃ. ১২৫)
গত চার দশকে এই শর্ত পূরণ তো হয়ইনি, বরং পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। কেবল বগুড়া জেলায় গত সাড়ে পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের হাতে আওয়ামী লীগারের খুনের ঘটনা ৩৬। ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩ প্রথম আলো প্রতিবেদন বলেছে, পাঁচ বছরে বগুড়ায় ক্ষমতাসীন দলীয় ৩১ জন খুন হন। এর মধ্যে ‘নিজেদের রক্তে নিজেরাই হাত রাঙিয়েছেন ২৯ জন। দখল, টেন্ডার ও চাঁদাবাজি এর কারণ। তিন দশকের বেশি ওই জেলার লীগ সভাপতির পদ আঁকড়ে থাকা নেতার সে জন্য কাউকে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য শাস্তি দিতে হয়নি। ‘আদালত তো আমার কাছে রিপোর্ট করে না’, খুনিরা কেউ শাস্তি পেল কি না, জানতে চাইলে ১১ অক্টোবর টেলিফোনে এই ছিল তাঁর মন্তব্য। শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে শাস্তি প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তি: ‘আওয়ামী লীগ খুনোখুনি করে না (অথচ অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন ১১)। আর গঠনতন্ত্রে সহযোগী সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আমার হাতে নেই।’ এই কৈফিয়ত, এই চিত্র দেশের প্রায় সর্বত্র। নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হওয়া ছাড়া অন্য কারণে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ পারতপক্ষে কাউকে বহিষ্কার করে না। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম বলেছেন, হাসপাতালের পাশে হাট বসানোটা ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ (ফৌজদারি অপরাধ)। আমলার ব্যাপারে তিনি স্পষ্টভাষী, কিন্তু প্রকৃত অপরাধী যে ইজারাদার যুবলীগ নেতা, যিনি বা যাঁদের ভয়ে ওই রকম প্রশাসকেরা তটস্থ, তাঁদের ক্রিমিনাল বলতে তিনি নারাজ।
মোহাম্মদ নাসিম সম্প্রতি বিএনপিকে বাণী দিয়েছেন যে ‘দল না গুছিয়ে নিয়ে আন্দোলন করলে সাত গোল খাবেন।’ তার মানে তাঁর নিজেরটি এতই ‘গোছানো’ এবং তার শক্তি এতটাই পরীক্ষিত যে তিনি মনে করেন ‘২০১৯ সালের এক ঘণ্টা আগেও নির্বাচন দিতে হবে না।’ আধুনিক রাষ্ট্রে ‘রাজনৈতিক দল’ এবং তার জবাবদিহির প্রশ্নকে ক্রমেই বড় করে দেখা হচ্ছে। গত এক দশকে বিশ্বে যাঁরা নতুন করে সংবিধান লিখেছেন, তাঁরাই ‘রাজনৈতিক দলের’ শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিকে সংবিধানের দেহে বিস্তারিতভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এখন ১১৬টি দেশের সংবিধানে এটা আছে। দলে শৃঙ্খলা না এলে সমাজে বা সরকারে শৃঙ্খলা আসবে না। দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মী সমাজে শান্তিভঙ্গের কারণ হবে, ÿক্ষমতার অপব্যবহার করবে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দল কিছুই বলবে না, আর সব জঞ্জাল সাফ করবে পুলিশ, দুদক কিংবা বিচারালয়—সেটা ভাবা আহাম্মকি।
২.
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কীভাবে প্রশাসন ও আইন-আদালতকে চাপে রাখে, তার একটি উদাহরণ দিই। ঝালকাঠি পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে দুই প্রার্থীই ছিলেন আওয়ামী লীগের। বিজয়ী হয়েছেন আফজাল হোসেন। নিকটতম ‘বিদ্রোহী লীগার প্রতিদ্বন্দ্বী’ লিয়াকত আলী তালুকদারকে অব্যাহতি, পরে তা প্রত্যাহারও হয়। কিন্তু নির্বাচনী কারচুপির দায়ে তাঁর অনুকূলে পাওয়া পুনর্গণনার রায় আর কার্যকর হয় না। কারণ, মেয়র সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ পান। ইতিমধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় লীগ সমর্থক কাউন্সিলর, ওই শহরের যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক, যিনি অন্যতম প্যানেল মেয়র, তাঁর নেতৃত্বে দলীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে থাকা মেয়রের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করেন। তাঁরা একজন এডিসিকে দিয়ে মেয়রের কতিপয় দুর্নীতি প্রমাণও করান। এরপর তাঁরা দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে নয়, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। আপনাদের এই গল্পের আরেকটু গভীরে নিয়ে যাব এটা দেখাতে যে সমস্যা, দল তার শৃঙ্খলার দাবি পূরণে মেটাতে পারত, সেটা কী করে আইনি গতি পায়।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মেয়রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। তাঁর নীরবতা ভাঙাতে রিট হলো। মেয়রের দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত হলেও কেন ব্যবস্থা নয়, ৬ অক্টোবরের মধ্যে উত্তর চেয়ে রুল হলো। ১ অক্টোবরে মেয়র বরখাস্ত হলেন। হাইকোর্টকে তা জানানোর আগেই হাইকোর্টে মেয়র পাল্টা নতুন রিট করলেন। ৫ অক্টোবর। ৪৪ মিন্টো রোড। সেখানে ছুটির দিনে বিচারকের বাসায় অবকাশকালীন বেঞ্চ বসেছে। ‘এটা এতটা জরুরি নয় যে এখানে এর শুনানি হতে হবে’—ওই বেঞ্চে যুক্তি দিয়েছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
খবর পাই, ওই ‘আইনি লড়াইয়ের’ নেপথ্যে একটি উচ্চতর দলীয় মাত্রা থাকতে পারে। কারণ, মেয়রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলার মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সম্পর্ক উষ্ণ নয়। একজন মেয়র-মিত্র, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য, তাঁকে ওই ছুটির দিনের বেঞ্চে আরজি হাতে দেখি। কিন্তু তিনি আদালতে এসেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে। সেখান থেকে মেয়র বরখাস্তের আদেশের ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ পেয়েছেন।
৯ অক্টোবরের অপরাহ্ণ। ওই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আমাকে টেলিফোনে বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল চেম্বার জজের আদালতে এসেছিলেন। ভ্যাকেশন বেঞ্চের আদেশ স্থগিত চেয়ে তাঁরা পাননি। এর শুনানি হবে ১৯ অক্টোবর। মেয়রের পক্ষে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির এক সদস্য চেম্বার জজের আদালতে আইনজীবী হিসেবে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। বিনয়ের সঙ্গে ওই জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে বললাম, হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে ওই মেয়রের বরখাস্তকরণ বিষয়টি বিচারাধীন ছিল। সেটা ছুটির দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ বা চেম্বার জজকে বলেছিলেন কি? তিনি বিস্মিত। ‘আমি এ কথা জানতাম না।’ বললাম, যদি জানতেন? তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘না। তাহলে ভ্যাকেশন বেঞ্চে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ জ্যেষ্ঠ আইন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের চোখও বিস্ময়ে ছানাবড়া!
একজন আইন কর্মকর্তা বললেন, ‘হাইকোর্টের আগের আদেশের কপি আপনার আছে নাকি?’ আমি তাৎক্ষণিক পাঠিয়ে দিই। কত জটিলতা দেখুন। আগের রিট না পরের রিট, কে কার ওপর প্রাধান্য পাবে? পরের আদেশ রিকল হতে পারে। মেয়র জ্ঞাতসারে তথ্য গোপন করলে তা হবে আদালত অবমাননা। কিন্তু তা তিনি করলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পদে থাকতে তাঁর অসুবিধা হবে না। ওই এলাকার নগর লীগ সভাপতি, যিনি প্রশ্নবিদ্ধ মেয়র নির্বাচনে হেরেছেন, তিনি যদি এই মেয়াদে আর কখনোই ব্যালট পুনর্গণনা না করাতে পারেন, সেটা হবে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, দল তার দায় নেবে না। ওই মেয়রকে বরখাস্ত করার আগে বিধিমতে ‘প্রসিডিংস’ জারি করা হয়েছিল কি? এ রকম প্যাঁচ কষে মেয়র তাঁর বাকি মেয়াদ পুরা করলে অবাক হব না। এসবই আসলে রুগ্ণ দলীয় শাসন। এভাবে বিভিন্ন স্থানে দলীয় বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আর নেতারা ‘আইনের শাসনের’ মহিমা প্রচার করে চলেছেন।
৩.
সন্দেহ নেই, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সম্পদ ও পদ–পদবি দখলে আরও মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাই ২০১১ সালে বছরে অন্তর্দলীয় সংঘর্ষে প্রতি মাসে তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখি। ২০১১ থেকে গত জুন পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার নেতা-কর্মী অন্তর্দ্বন্দ্বে আহত হয়েছেন। এই সময়ে বিএনপি-জামায়াত বনাম আওয়ামী লীগ কোন্দলে নিহত ১৩৩। আহত হয়েছে সাড়ে সাত হাজার (সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র)। ৫ জানুয়ারির পরও আওয়ামী লীগের অন্তর্দলীয় খুনোখুনি যে বন্ধ হয়নি, নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর হত্যাকাণ্ডই এর প্রমাণ।
পুনশ্চ: আমরা যে বিচার বিভাগীয় কমিশনের কথা বলেছি, সেই কমিশনের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হতে পারে ভারতের কংগ্রেস, দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্তর্দলীয় কোন্দল–সহিংসতার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের অন্তর্দলীয় কোন্দল ও সহিংসতার তুলনামূলক চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.