শিক্ষাব্যবস্থার ফাউন্ডেশনেই গলদ by সাহস রতন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের কারণে গত কিছুদিন থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। গোল্ডেন জিপিএ প্রাপ্ত অনেক শিক্ষার্থী ঢাবি ভর্তি পরীক্ষার প্রাথমিক বাছাই পর্বে বাদ পড়েছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, ঢাবি ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে ত্রুটি রয়েছে। ভিসি বলছেন, পরীক্ষা পদ্ধতি ঠিকই আছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, পাবলিক পরীক্ষায় মেধা তালিকার শীর্ষে থাকা ছাত্রছাত্রীরাই ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন এমন অনেক গবেষক এটা স্বীকার করেছেন, আমাদের সিস্টেমে কোথাও গলদ রয়েছে। হয় পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন কিংবা খাতা যাচাই পদ্ধতি নয়তো উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি। কোথাও না কোথাও ঘাপলা তো একটা আছেই। তা না হলে, এমন হবে কেন?
শিক্ষাকে বলা হয় জাতীর মেরুদণ্ড। আর এ মেরুদণ্ডের ফাউন্ডেশন প্রাথমিক শিক্ষা। প্রতিটি বিল্ডিংয়ের একটা ফাউন্ডেশন থাকে যার ওপর ভিত্তি করে সেই বিল্ডিংটি দাঁড়িয়ে থাকে। একতলা বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন দিয়ে পাঁচতলা একটা বিল্ডিং বানালাম। তারপর দোতলা থেকে উপরের দিকে টাইলস, বিদেশী ফিটিংস দিয়ে যতই চকচকে ঝকঝকে করি না কেন, সেই বিল্ডিং তো টিকবে না। আজ হোক কাল হোক সেটা ধসে পড়বেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার ফাউন্ডেশন প্রাইমারি স্কুলগুলোকে অবহেলিত রেখে আমরা শিক্ষিত জাতি গঠনের অযৌক্তিক খেলায় লিপ্ত থেকেছি। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সেজন্য প্রথমেই দৃষ্টি ফেরাতে হবে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে। বিশেষত সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে। একটা ফুলের বাগান গড়তে চাইলে এক খণ্ড জমি লাগবে। ভাল ফুলের চারা লাগবে। বর্ষার আগে জমির মাটি তৈরি করে সেই চারা রোপণ করতে হবে। তারপর সময়মতো পানি ঢালতে হবে, নিড়ানি দিয়ে সার দিতে হবে। তবেই বছর শেষে বাগানে ফুল আশা করতে পারেন আপনি। আবার সব কিছু ঠিক থাকালেও জমিটিতে যদি পর্যাপ্ত সূর্যালোক না পড়ে তাহলেও হয়তো ফুল ফুটবে না। কিংবা রাস্তার মাঝখানে ভাল চারা রোপণ করলেও তো সেখানে ফুল ফোটানো যাবে না। তার মানে হলো, একটা ফুলের বাগান গড়তে হলে যেমন লাগবে ভাল চারা ও সার্বক্ষণিক পরিচর্যা, তেমনি লাগবে আলো-বাতাসপূর্ণ জমিও। এর কোন একটি বাদ পড়লে হবে না। সাধারণ একটা ফুলের বাগান গড়তেই কত শ্রম দিতে হয়। আর আমরা আশা করছি যেনতেনভাবে একটা ঘর বানিয়ে কিছু মানুষ ওখানে নিয়োগ দিয়ে দিলাম। আর মানুষ তৈরি হতে থাকবে। আহাম্মকিরও একটা সীমা থাকা উচিত! সারা দেশে প্রায় ৩৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। আপনি এর যে কোন একটিতে ঢুঁ মারেন। দেখবেন, একটি ক্ষয়িষ্ণু ভবন। প্লাস্টার খসে পড়ছে। চারদিকে মাকড়সা জাল, ধুলোবালি, ভাঙাচোরা চেয়ার-টেবিল। আর শিক্ষকদের কথা কি বলবো। শিক্ষকদের বলা হয়, মানুষ গড়ার কারিগর। কারিগরের কোয়ালিটি যেমন, তেমন পদার্থই তো তিনি তৈরি করবেন। কি ধরনের মানুষ আমাদের শিক্ষকগণ বিগত ৪০ বছর ধরে উৎপাদন করেছেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, ক্লাসের সবচেয়ে কম মেধাবী ছাত্রছাত্রীটি, যে নিজেকে অন্য কোথাও উপযুক্ত করতে ব্যর্থ, তারাই মূলত প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। এ দিয়ে এর চেয়ে ভাল আর কি আশা করতে পারি আমরা?
শিক্ষক সঙ্কটে ভুগছে গোটা জাতি। ভাল শিক্ষকের অভাব আমাদের জাতীয় সমস্যা। একটা সেমিনারের আয়োজন করলাম সাহস স্কুল আঙিনায়। সেমিনারের বিষয় ‘প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক সঙ্কট ও উত্তরণের পথ সন্ধান’। আলোচনার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যেমন: মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতায় আসতে চায় না, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো আকর্ষণীয় নয়, শিক্ষকদের সামাজিক স্বীকৃতি নেই- এরকম অন্তত দশটি ইস্যু উঠে এলো। এগুলো পুরোনো সমস্যা, সবাই জানেন। কিন্তু এত বছরেও সমাধান হয়নি। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা রয়ে গেছে পুরোপুরি অবহেলিত। শিক্ষিত জাতি গড়তে চাইলে শিশুর মেধার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য দরকার পর্যাপ্ত পরিচর্যা, সার্বিক সহযোগিতা ও শিক্ষা উপযোগী পরিবেশ। অবশ্যই শুরুটা হতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আজই কাজ শুরু করলে ১৫ বছর পর থেকে শিক্ষিত প্রজন্ম আশা করতে পারবো আমরা। নয়তো, এবারের মতো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে বারবার। সে দিকেই মনে হয় ছুটছে সবাই।

No comments

Powered by Blogger.