কাতারের জিহাদ by ব্রহ্ম চেলানি

দেশ হিসেবে কাতার ছোট হলেও পুরো আরব দুনিয়ায় তার প্রভাব রয়েছে। দেশটি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় সহিংস জিহাদিদের সমর্থন দিয়েছে, আবার যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবিরোধী লড়াইয়েও সমর্থন জুগিয়েছে। গ্যাসসমৃদ্ধ এই দেশের মাথাপিছু আয় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তারা একটি আঞ্চলিক মক্ষিকা থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরের বদমাশ হাতিতে পরিণত হয়েছে। প্রভূত সম্পদ কাজে লাগিয়ে কাতার ইসলামি মৌলবাদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে, সঙ্গে আছে দেশটির অমিত উচ্চাভিলাষ। কাতারের জমকালো রাজধানী দোহায় ঝাড়বাতি দিয়ে অলংকৃত বিশাল যে মসজিদ রয়েছে, সেটি মৌলবাদীদের মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে এই মৌলবাদীরা ইয়েমেন, তিউনিসিয়া ও সিরিয়ার মতো দেশগুলোয় জিহাদ করতে চলে যাচ্ছে। ফলে কাতার ইসলামি মৌলবাদীদের কাজে লাগানোয় এখন আরেক ওয়াহাবি রাষ্ট্র সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে—সৌদি আরবের হাতেও অমিত পরিমাণ সম্পদ আছে।
কিন্তু কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তফাত আছে। কাতারের ওয়াহাবি ধারা সৌদি আরবের ওয়াহাবি ধারার মতো অতটা কট্টরপন্থী নয়। যেমন কাতারের নারীরা একা একা চলাফেরা করতে পারেন বা গাড়ি চালাতে পারেন। কাতারে নৈতিকতা পালন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোনো ধর্মীয় পুলিশ বাহিনী নেই, এমনকি কাতারের ধর্মবেত্তারা দেশের বাইরের জঙ্গি তৎপরতার জন্য প্রকাশ্যে অর্থ তুলতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এটা কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে, সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতারা কট্টরপন্থী ইসলামের ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করলেও কাতারের তরুণ রাজতন্ত্রীরা ভবিষ্যৎমুখী নীতি গ্রহণ করবেন। আল-জাজিরার টিভি স্টেশন কাতারে অবস্থিত, এটা শিক্ষানগরও বটে—দোহার বাইরে অন্য আরেকটি শহরে সব বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্র অবস্থিত। কাতারের পররাষ্ট্রনীতিতেও এরূপ অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। দেশটি একদিকে ইসলামি মৌলবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কিত, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্কিত।
আল উদেইদ বিমানঘাঁটি কাতারে অবস্থিত, সেখানে আট হাজার সামরিক কর্মকর্তা ও ১২০টি বিমান আছে। এমনকি সুপার ট্যাংকারও আছে সেখানে, যার মাধ্যমে যুদ্ধের সময় জ্বালানি সরবরাহ করা যায়। এ ঘাঁটি থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলা চালাচ্ছে। আস সাইলিয়াহর মতো ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কমান্ডের ফরওয়ার্ড সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এর জন্য কাতার কোনো ভাড়া ধার্য করে না। এ বছরের জুলাই মাসে কাতার ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের মার্কিন অস্ত্র কিনবে। তার পরও ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্র ধরে কাতার পশ্চিমা জিম্মিদের মুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান-সমর্থিত তালেবানদের মধ্যে একটি গোপন আলোচনাও অনুষ্ঠিত হয়েছে কাতারে। এই আপসরফার জন্য কাতার একটি বাড়ির ব্যবস্থা করে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সে কাজটি করেছে, এটা কার্যত তালেবানদের কূটনৈতিক মিশন হিসেবে কাজ করেছে। এ বছরের শুরুতে গুয়ানতানামো কারাগার থেকে যে পাঁচজন আফগান তালেবান নেতা মুক্তি পেয়েছেন, তাঁরাও সেখানে বাস করছেন।
অন্য কথায়, কাতার একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, ইসলামপন্থীদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহকারী এবং শান্তির ফেরিওয়ালা। এর সঙ্গে আরও কিছু যুক্ত করতে হবে: বিশ্বের তরল গ্যাসের সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী, সর্ববৃহৎ সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের মালিক। ফলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, কাতারের হাতে কৌশল করার মতো অনেক কিছুই আছে। আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা তার রয়েছে। আরব দুনিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বিধানে কাতারের এই ক্রমবর্ধমান প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত, দেশটির সঙ্গে সৌদি আরবের দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে এটি আরও বিশেষভাবে সত্য। দেশ দুটির এই পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি সম্প্রতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এতে বোঝা যায়, দেশটি যে দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি মৌলবাদ রপ্তানির লাইনে ছিল, সেখান থেকে তারা পিছু হটে আসছে।
কাতার ও সৌদি আরব উভয়ই সিরিয়ার সুন্নি জঙ্গিদের উদারভাবে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করেছে, এর ফলেই আইএসের উদ্ভব হয়েছে। উভয়ই আফগান তালেবানদের শক্তিশালী করেছে। লিবিয়া যে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হলো, তার পেছনেও রয়েছে এই দুই রাষ্ট্র, ইসলামি জঙ্গিদের পালে হাওয়া দেওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। ২০১১ সালে ন্যাটো যখন কর্নেল মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে অপসারণে অভিযান শুরু করে, কাতার তখন লিবিয়ায় গোপনে সেনা পাঠিয়েছিল। তবে আজ সৌদি আরব ও কাতার বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। তুরস্ক ও কাতার ইসলামি আন্দোলনে তেল-জল জোগায়। ফলে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও জর্ডানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে কাতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে।
এ অর্থে কাতারের এই গুঁতোগুঁতিতে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলে কিছুটা ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে দুনিয়ার মোট তেলসম্পদের প্রায় অর্ধেকের মালিক। বিবদমান রাজতন্ত্রগুলোর মধ্যকার এই প্রক্সি প্রতিযোগিতার ফলে এই দেশগুলোর অনেকেই কাতার থেকে গত মার্চ মাসে তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে এই এলাকাজুড়ে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ছে। কাতারের নেতারা সাধারণ কারণেই তাঁদের প্রতিবেশীদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। তাঁরা মনে করেন, যে তৃণমূলভিত্তিক ইসলামি আন্দোলনে তাঁরা সমর্থন দিচ্ছেন, সেটা শেষমেশ জয়ী হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণ এটা সমর্থন করে। কাতার মনে করছে, এসব গ্রুপই ভবিষ্যতে আরব দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করবে, ফলে তারা খোলাখুলি নেমে গেছে। এটা করতে গিয়ে কাতার বিভিন্ন দেশেই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। এমনকি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশগুলোকেও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই বন্য হাতিকে বশ মানাতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিসের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.