ইবোলা- মানবজাতির জন্য এক নয়া হুঁশিয়ারি by আলমগীর মহিউদ্দিন

অবশ্যই প্রতিবাদ করত যদি নদীটি কথা বলতে পারত। বলত আমার নাম ছিনিয়ে নিয়ে ওই পাষণ্ড হত্যাকারীকে দিয়ো না। ১৯৭৬ সালে এ নদীতীরের এক গ্রাম ইয়ামবুকোয় চল্লিশোর্ধ কৃষক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। কোনো চিকিৎসায় কাজ হলো না। বরং একপর্যায়ে তার চোখ-কান-নাক দিয়ে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়ে তার মৃত্যু হলো। এমন অদ্ভুত রোগের কথা চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা শোনেননি। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের ডাইরেক্টর অধ্যাপক পিটার পিওটের নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা এলেন সে গ্রামে। কঙ্গোর বিখ্যাত ২৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ইবোলা নদীর তীরে গ্রামটি। বিজ্ঞানীরা বললেন, এ রোগের নাম ইবোলাই হোক। এখন সারা বিশ্বের মানুষ ইবোলা বলতে কঙ্গোর পাঁচটি নদীর উৎস এ নদীর নাম বলে মনে করে না। বরং এ বছর এর প্রতাপ ও প্রকাশ দেখে সবাই ভীত। কারণ সংক্রামক এ রোগটির কোনো চিকিৎসা আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে নেই। রোগটি নিজের ইচ্ছেয় আক্রমণ করছে, আবার এমনিতেই লুকিয়ে যাচ্ছে। গত ৩৮ বছর ধরে এ রোগের কর্মকাণ্ড চোখের আড়ালে দক্ষিণ আফ্রিকার সিওরোলিওন, গিনি ও লাইব্রেরিয়াতে চলছিল। মৃত্যু সংখ্যা বিশাল কিছু ছিল না। তবে কেউ আক্রান্ত হলে সুস্থ হতো না। কিন্তু এবার ইবোলা সবাইকে একটু একটু করে স্পর্শ করছে এবং ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে; যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলতে বাধ্য হয়েছেন এটা এখন ‘আন্তর্জাতিক বিশেষ স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা।’
বিশ্বের মধ্যে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই স্বাস্থ্য বিষয়ে সবচেয়ে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দেখা যায়। ইবোলাকে নিয়ে তাদের শঙ্কার কারণে ডানকান পশ্চিম আফ্রিকায় গিয়েছিলেন ইবোলা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে। সেখানে গিয়ে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। পরে মারা যান। যারা তাকে দেখতে গিয়ে একটু মাথায়-গায়ে হাত বুলিয়েছিল, সবাই পরে ইবোলায় আক্রান্ত হন। এমনিভাবে স্পেনের নার্স তেরেসা রোমেরো আক্রান্ত হন। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি বিমান বন্দরে চেক পোস্ট বসানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনসন (সিডিসি) ঘোষণা করেছে, যে হারে ইবোলা প্রসারিত হচ্ছে তাতে অতি শিগগিরই ১৫ লাখ লোক আক্রান্ত হবে। উল্লেখ্য লাইবেরিয়ার চিফ মেডিক্যাল অফিসার বার্নিস ডান এবং সিওরোলিয়নের প্রধান ইবোলা চিকিৎসক শেখ উমর খান ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন।
ইবোলায় আক্রান্ত হয় কেমন করে? এক কথায় স্পর্শে। আক্রান্ত ব্যক্তির ঘাম বা রক্ত কোনোক্রমে অন্যকে স্পর্শ করলে এ রোগ হবে এবং মৃত্যু অবধারিত। সে জন্য এ পর্যন্ত দেখা গেছে স্বাস্থ্যকর্মী, পরিবারের সদস্য, সমবেদনা জানানো ব্যক্তিরা বা কবর দেয়ার কর্মীরা ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে বিশেষভাবে আবৃত থেকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সব বস্তু থেকে দূরে থাকলে আক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই। কারণ ইবোলা সংস্পর্শদ্বারাই সঞ্চালিত হয়।
ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন কি না বোঝার উপায় কি? হঠাৎ জ্বর শুরু হবে, ভীষণ দুর্বলতা অনুভব করবেন, সারা শরীর ব্যথা করবে, মাথা ধরে, গলা খুশখুশ করবে। এরপর শুরু হবে বমি, প্রস্রাবে অসুবিধা হবে। লিভারের কার্যক্রম বন্ধ হবে। শেষ প্রান্তে এসে চোখ-মুখ-কান দিয়ে রক্তপাত হতে থাকবে। আক্রান্ত হওয়ার ২ থেকে ২১ দিনের মধ্যে এসব উপসর্গ দেখা দেয়। তবে একজন সুস্থ লোক যদি আক্রান্ত ব্যক্তিকে এ উপসর্গ প্রকাশ হওয়ার আগে স্পর্শ বা একত্রিত হয় তবে কোনো আক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই। তবে ইবোলায় মৃত ব্যক্তিকে স্পর্শ করার সাথে সাথে সংক্রমিত হতে পারে।
দেখা গেছে সংক্রমিত ব্যক্তি প্রচলিত কিছু সেবাতেই ভালো হয়ে গেছে। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা এখনো স্থির করতে পারেননি কোন চিকিৎসায় এর নিরাময় সম্ভব। তাই এখন একটিমাত্র পন্থা ব্যবহৃত হচ্ছে। সংক্রমিত ব্যক্তিকে পূর্ণভাবে পৃথক (কোয়ারান্টাইন) রাখা হচ্ছে। সেখানে প্রচলিত চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হয়ে গেলে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে তিন মাস পর্যবেক্ষণে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির বীর্যে ইবোলা ভাইরাস ৮১ দিন পর্যন্ত মৃত্যুর পরও দেখা গেছে। এ পর্যন্ত ৫০ থেকে ৯০ ভাগ আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন এ ইবোলার বিরুদ্ধে কেন কোনো ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা গত ৩৮ বছরে তৈরি হয়নি? যারা একটু সিনিক তারা বলছেন যেহেতু রোগটি আফ্রিকায় উৎপত্তি তাই অবহেলা। তবে চারবার মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর চারটি বিখ্যাত কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরি করেছে।  সম্প্রতি এগুলো পরীক্ষাপর্যায়ে একটি ভ্যাকসিন চারজনের ওপর প্রয়োগ করা হলে দুইজন নিরাময় হন। সমালোচকেরা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে নিন্দা করছেন এ বিষয়ে মনোযোগ না দেয়ার জন্য। বিখ্যাত ব্রিটিশ স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন ল্যানসেট ইউরোপকে এগিয়ে আসতে বলছে। “তারা যদি না এগিয়ে আসে তাহলে এবার ভূ-রাজনৈতিকবিপর্যয় হবে (ফেস জিওপলিটিক্যাল ক্রাইসিস)”। এর কারণ ইবোলা এখন আর আফ্রিকায় সীমিত নেই। ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ ইউরোপে এর প্রকাশ লক্ষ করা গেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ংকিম বলেছেন, ইবোলা যদি সর্বাত্মক চেষ্টা করে তিনটি দেশেই সীমাবদ্ধ করা যায় তাহলে খরচ হবে ৯ বিলিয়ন ডলার। নতুবা যেভাবে প্রসারিত হচ্ছে তাতে খরচ ৩২ বিলিয়ন ডলারে ঠেকবে।
ইকোলজিক্যাল ইন্টারনেটের প্রতিষ্ঠাতা ড. গ্লেন ব্যারি উল্লেখ করছেন, ইবোলার আবির্ভাবের কারণ সামাজিক অবক্ষয় এবং পরিবেশের ওপর অত্যাচার। মানুষ ক্রমান্বয়ে পরিবেশ ধ্বংস করছে। যেমন পশ্চিম আফ্রিকার ৯০ শতাংশ বন এখন আর নেই।
উন্নয়নের জন্য বাইরের শক্তি বন ধ্বংস করছে আর বাঁচার জন্য স্থানীয় দরিদ্র মানুষেরা তাতে সাহায্য করছে। নিউ সায়েন্স পত্রিকায় এ সপ্তাহেই এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত ৪০ বছরে বিশ্বের ৫০ শতাংশ বন্যপ্রাণী নিধন করা হয়েছে। আবার যুদ্ধ-বিগ্রহ মহামারীর জন্য দায়ী। ড. ব্যারি দেখিয়েছেন প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী যে ফু মহামারী হয় তাতে দশ কোটি মানুষ মারা যায়। তিনি বলেছেন এখন বিশ্বব্যাপী চলছে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা এবং অস্ত্র প্রস্তুতকারীরা বিভিন্ন দেশে সঙ্ঘাত যুদ্ধ উসকে দিয়ে স্থানীয় যুদ্ধের আয়োজন করছে। এসব দেশের জরা ব্যাধির প্রকোপ অনেক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার প্রকাশ নেই।
২০০৪ সালে ব্যাংককে এইডস সামিটেও এ সতর্কবাণী দেয়া হয়েছিল যে যুদ্ধ-সঙ্ঘাত নানা রোগেরও উৎপত্তি ঘটায়। এক গবেষক খানিকটা আধ্যাত্মিক মন্তব্য করেছেন। সঙ্ঘাত, যুদ্ধের পরেই রোগের বিস্তৃতির কারণ এটা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে একটি হুঁশিয়ারি। তবে ক্ষমতার মোহ এবং দ্বন্দ্বে মানুষ এ হুঁশিয়ারিকে গ্রহণ করে না।
ইবোলাকে নিয়ে কি বাংলাদেশের শঙ্কার কারণ আছে? এর উত্তর হ্যাঁ এবং না।
হ্যাঁ, এই অর্থে যে গত সপ্তাহে এক জাপানি মহিলা ভারতের নাগার ইম্ফলে গিয়ে জ্বরে আক্রান্ত হন। তাকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে তিনি ইবোলায় আক্রান্ত। কাওয়াকুবো ইউকো (২৭) গাড়িতে মিয়ানমার থেকে ইম্ফলে গিয়েছিলেন। তার সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন সবাইকে এখন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ মাত্র একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ রোগটি ছড়ায়। ভারতে চিকিৎসাব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়। তাহলে অবস্থা কী হবে জানা যায়নি। এ দিকে ওই মহিলা মিয়ানমার থেকে ইম্ফলে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ কি খুব দূরে?
বাংলাদেশের বহুমানুষ এখন পশ্চিম আফ্রিকায় এবং তারা আসা-যাওয়া করছেন। এ দেশের কোনো বিমান বন্দরে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের কোনো স্থাপনা নেই। তাই অবশ্যই বলা চলে বাংলাদেশ নিশ্চিত হতে পারে না। তবে একটিই আশা। পশ্চিম আফ্রিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনী প্রেরণ করেছে আর ইউরোপ চিকিৎসক বাহিনী পাঠিয়েছে। সেখানে যদি ইবোলায় ট্রান্সমিশন রোধ করা যায় তাহলে হয়তো বিশ্বব্যাপী কিছু ক্ষতির পর এই ফু, ক্যানসার ও এইডসের মতো খানিকটা সহনীয় হবে। এপির খবরে বলা হয়েছে এর মধ্যে মার্কিন ১০১ এয়ারবর্ন ডিভিশন লাইবেরিয়া পৌঁছেছে। শুধু আশা মানবজাতির জন্য এ হুঁশিয়ারি ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন দুই দলেই গ্রহণ করবে।

No comments

Powered by Blogger.