অন্যের দখলে শ্যামাসুন্দরী -জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে

রংপুর নগরীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরী খালের বেশির ভাগই দখল হয়ে গেছে। সাত বছরেও এ খালের সংস্কার কাজ শেষ হয়নি। খালের বিষাক্ত পানি পরিবেশ দূষণ করে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এদিকে খাল সংস্কারের নামে টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ও  স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী। শ্যামাসুন্দরী খালটি এখন আশীর্বাদের পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। অথচ দখল হওয়া জমি উদ্ধারে কোন পদক্ষেপও নেই। এলাকাবাসী জানায়, রংপুর নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করতে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকি বলভ সেন ১৮৯০ সালে তার মা চৌধুরানী শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে ক্যানেলটি খনন করেন। ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ শ্যামাসুন্দরী খালের সম্মুখে নগরীর কেলাবন্দের পেছনে ঘাঘট নদী। এটি ঘাঘট নদী থেকে শুরু করে ধাপ পাশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সিপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, গোমস্তপাড়া, সেনপাড়া, মুলাটোল, তেঁতুলতলা, নূরপুর, বৈরাগীপাড়া হয়ে মাহিগঞ্জের মরা ঘাঘটের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না করায় খালটি নাব্য হারিয়ে ফেলে। এর দুই ধারের জমি অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় সংকীর্ণ হয়ে পড়ে খালটি। সামান্য বৃষ্টিতেই গোটা শহরে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ১১৭ বছর পর ২০০৭ সালে পৌরসভা ক্যানেলটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংস্কার কাজ শেষ না হওয়ায় নগরবাসীর মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। এদিকে নগরীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান খাল শ্যামাসুন্দরীর সংস্কার কাজ ৭ বছরেও শেষ হয়নি। প্রথম দফার প্রকল্প শেষে এখন চলছে দ্বিতীয দফার কাজ। আড়াই বছরে দ্বিতীয় দফা প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়েছে অর্ধেক। চলতি বছরের জুনে এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরেজমিন খাল এলাকা ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব নানা অনিয়ম। খালের মাটি কাটার কাজ, গাইড ওয়াল নির্মাণ পার্ক স্থাপন এখনও চোখে পড়ছে না। যে কাজ করা হয়েছে তা আবার মাটিতে ভরে গেছে। আবার অনেক স্থানে কাজ না করেই কাজ করা হয়েছে বলে দেখানো এবং বিল উত্তোলন করা হয়েছে। এদিকে দীর্ঘদিন খনন না করায় খালটির বেশির ভাগ স্থান ময়লা-আবর্জনার বাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বদ্ধ পানিতে দুর্গন্ধ ও মশার বংশ বিস্তার ঘটছে। যা জনস্বাস্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে তৎকালীন পৌরসভার অধীনে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে খালটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। এতে খাল পুনঃখনন, গাইড ওয়াল স্থাপন, জজ কোর্ট ও কেরামতিয়া জামে মসজিদের কাছে পার্ক স্থাপন অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রকল্প চলাকালে স্বেচ্ছায় খাল পুনঃখননসহ আর্থিক সহায়তা করে আরডিআরএস ও কেয়ারসহ বেসরকারি কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থা। এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে কেরামতিয়া মসজিদ সংলগ্ন খালের ১ কিলোমিটার জায়গা পুনঃখনন ও পার্কের ফুটপাথের বেজমেন্ট নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এরপর ২০১১ সালের শুরুতে দ্বিতীয় দফায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় শ্যামাসুন্দরীর খালের সংস্কার কাজ। আংশিক বাস্তবায়নের পর রংপুর পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তর হয়। এরপর খালটির কাজ সিটি করপোরেশন থেকে এলজিইডি’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন নবনির্বাচিত মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু সংবাদ সম্মেলন ও পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে জনসভা করে শ্যামাসুন্দরীর সংস্কার কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি শ্যামাসুন্দরী খালের কাজ সিটি করপোরেশনে অধীনে দেয়ার দাবি জানান। শ্যামাসুন্দরী খাল পাড়ের বাসিন্দা মাহমুদ হাসান ও সোলেমান মিয়া বলেন, খাল সংস্কারের নামে হরিলুট করা হয়েছে টাকার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এলজিইিডির রংপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খাল সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ছয়টি প্যাকেজে কাজ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে আট কিলোমিটার স্নোপ প্রটেকশন ও দুই পাশে ফুটপাত নির্মাণ, তিনটি ব্রিজ নির্মাণ, একটি ব্রিজ বর্ধিতকরণ ও একটি বক্স কালভার্ট নির্মাণ। সরেজমিন দেখা যায়, ২০০৭ সালে প্রথম দফার প্রকল্পে পিটিআই থেকে পাশারীপাড়ার দিকে নির্মিত রাস্তার অস্তিত্ব নেই। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার পাড়ায় নতুন ব্রিজ  থেকে পুরনো ব্রিজ পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে এমন রাস্তার দেখা মেলেনি। খালটির প্রস্থ স্থানভেদে ৬০ থেকে ১২০ ফুট হলেও খালের প্রশস্ত ১৫ ফুটে নামিয়ে এনে দু’পাশে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা সেপটিক ট্যাংক তৈরি না করে খালের মধ্যে মল-মূত্রসহ বিভিন্ন বর্জ্য ফেলছেন। এদিকে খাল ভরাট হয়ে ডোবা-নালায় পরিণত হয়েছে। রংপুর এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, কাজে কোন অনিয়ম হয়নি। নিয়ম মাফিক কাজ চলছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার ফলে ও নির্বাচনের কারণে সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জুন মাস পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের মেয়র সরফুদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সংস্কারের নামে টাকা হরিলুট করা হচ্ছে। এছাড়া খালের প্রশস্ততা ১৫ ফিট রেখে সংস্কার কাজ শুরু করায় দু’পাশের ৩০ থেকে ৪০ ফিট অবৈধ দখলে চলে গেছে। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কারসহ বিভিন্ন কাজে সাবেক পৌর মেয়রসহ কর্মকর্তারা নানা অনিয়ম দুর্নীতি করেছে। টাকা লুটপাট করা হয়েছে। লুটপাটের কারণে একদিন জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে তাদের।

No comments

Powered by Blogger.