দেশে ফিরছেন না লতিফ সিদ্দিকী by আশরাফ আলী

আপাতত আর দেশে ফেরা হচ্ছে না সদ্য মন্ত্রিত্ব হারানো বিতর্কিত আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিক আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর। দেশে ফিরলেই তাকে গ্রেফতার করা ছাড়া সরকারের বিকল্প থাকবে না। অন্যথায় নিজের পাশাপাশি মানুষের রোষানলে পড়তে হবে সরকারকেও। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মুহূর্তে আর তিনি দেশে ফিরতে চান না বলে তার ঘণিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। তা ছাড়া তিনি এখন কোথায় অবস্থান করছেনÑ তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলছেন না। গত রোববার দিল্লি থেকে কলকাতায় পৌঁছলেও পরদিন থেকেই লাপাত্তা ৭৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিক। কলকাতার কোথাও তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণেই নাকি আলোচিত এই রাজনীতিকের অবস্থান প্রকাশ করছে না দেশটির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। যদিও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কলতাকায় গণমাধ্যমে বলেছেন, তিনি দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন, এখনি দেশে ফিরে আরো বিব্রতকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে চান না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কলকাতায় থাকার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন তিনি। তবে কলকাতার কোথায় থাকবেন তা জানা যায়নি।

এ দিকে লতিফ সিদ্দিকীর পরিবারের ঘণিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তিনি কলকাতায় অবস্থান করছেন। স্ত্রী-কন্যাসহ তিনি নিউ ইয়র্ক গেলেও কলকাতায় স্ত্রী-কন্যাসহ এসেছেন কি না তা অবশ্য জানা যায়নি। দেশে অবস্থানকারী একমাত্র ছেলে অনিক সিদ্দিকী বাপ্পীও তার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত পরশু কলকাতায় গেছেন। লতিফ সিদ্দিকীর দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে বড় মেয়ে কানাডায় বসবাস করছেন। ছেলে বাপ্পী তিনি দেশেই ছিলেন। যদিও অনিক সিদ্দিকী বাপ্পী বাবা-মার সাথে মন্ত্রীপাড়ার বাসায় থাকতেন না। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়–য়া এই ছেলে একাই গুলশানের বাসায় বসবাস করতেন। তিনিও চলে যাওয়ায় বর্তমানে দেশে লতিফ সিদ্দিকীর পরিবারের কোনো সদস্য আর নেই। অর্থাৎ সপরিবারে তিনি এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। সম্প্রতি বিবিসির সাথে ইন্টারভিউ দেয়ার পর থেকে দেশে তার ঘণিষ্ঠ বলে পরিচিত কারো টেলিফোন তিনি আর ধরছেন না বলে তারা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিযেছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, লতিফ সিদ্দিকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লন্ডন হয়ে দিল্লি আসেন। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে দেখা করার চেষ্টা করেন। উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ম্যানেজ করা। কিন্তু সেখানে প্রণব মুখার্জির সাথে সাাতের কোনো সময় তিনি পাননি। কারণ গত রোববারই প্রণব মুখার্জি নরওয়ের উদ্দেশে দিল্লি ছেড়েছেন বলে ভারতীয় সূত্র জানিয়েছে। পরে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। সেখান থেকেও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। এ পর্যায়ে তিনি দেশে ফেরা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন। বাংলাদেশে ফিরবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। ফিরলে তাকে কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবেÑ তা জানার জন্য পশ্চিমবঙ্গে তার ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করেন। দেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট ও দলের সর্বশেষ অবস্থান জানার চেষ্টা করেন। সর্বোপরি দল ও দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোভাব জানার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো দিক থেকেই তিনি অনুকূল ইঙ্গিত না পেয়ে আপাতত দেশে না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সেখানে তিনি এখন গোপন অবস্থানে রয়েছেন। পরিস্থিতি বুঝে তিনি কলকাতা থেকে দিল্লি ফিরে যেতে পারেন এবং সেখানেই আপাতত অবস্থান করতে পারেন বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
যদিও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লতিফ সিদ্দিকী ‘রেগুলার ভিসা’য় বর্তমানে কলকাতায় রয়েছেন। চিকিৎসাও করাতে পারেন তিনি। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচিত এই রাজনীতিকের আবাসস্থল প্রকাশ করতে চান না কর্মকর্তারা। এ দিকে নিউ ইয়র্কে যে মন্তব্যের জন্য লতিফ সিদ্দিকীকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই বলে জানিয়েছেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। যাকে এখন দল থেকেও বহিষ্কারের প্রক্রিয়া চলছে। তবে দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো খেদ নেই তার। দলকে বিব্রতকর অবস্থার মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য অনুতাপ রয়েছে তার। মন্ত্রিসভা ও দলীয় পদ থেকে বাদ পড়ার পর দিন সোমবার বিবিসি বাংলাকেও দীর্ঘ এক সাাৎকারে তিনি এসব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। ওই সাাৎকারে স্বভাবসুলভ ভঙিতে ছোট ভাই আবদুল কাদের সিদ্দিকী তার হয়ে মা চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই ব্যাটাকে আমার প থেকে মা চাওয়ার অধিকার কে দিলো? আমি তো তাকে এই দায়িত্ব দেই নাই যে আমার পে মা চাও।’
চূড়ান্ত বহিষ্কারের আগে আ’লীগের শোকজ নোটিশ টাঙ্গাইলের ঠিকানায়
লতিফ সিদ্দিকীকে কেন আওয়ামী লীগ থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শাও নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর জিগাতলা পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্ট্রি ডাকে লতিফ সিদ্দিকীর টাঙ্গাইলের কালিহাতির স্থায়ী ঠিকানায় ওই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে হজবিরোধী বক্তব্য দেয়ায় কেন চূড়ান্তভাবে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে নাÑ তা জানতে চাওয়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তাকে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে। যদিও এর প্রতিক্রিয়ায় কলকাতায় অবস্থানরত লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, নোটিশ হাতে পেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমি আমার জবাব দেবো। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা বলেন, গত রোববার আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্তের আলোকেই লতিফ সিদ্দিকীকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে, যাতে সই করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সংগঠনের আদর্শ ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে লতিফকে কারণ দর্শানোর এই নোটিশ দেয়া হয়েছে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর পদ থেকে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও ওই নোটিশে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে যে বক্তব্য লতিফ সিদ্দিকী দিয়েছিলেন তা উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়েছে, ‘আপনার এ বক্তব্য কেবল গর্হিত ও অনভিপ্রেতই নয়, বাংলাদেশ ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি আঘাতস্বরূপ। তা আওয়ামী লীগের নীতিবিরোধী এবং আদর্শ ও গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লংঘন।’
লতিফকে সভাপতিমণ্ডলীর পদ থেকে বাদ দেয়ার েেত্র আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৬ ‘ক’ অনুচ্ছেদের উল্লেখ করা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের আদর্শ, ল্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করলে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল, কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড বা সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ তার বিরুদ্ধে যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’
গঠনতন্ত্রের ৪৬ ‘ঞ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংগঠনের যেকোনো শাখা তার যেকোনো কর্মকর্তা বা সদস্যকে দলের স্বার্থ, আদর্শ, শৃঙ্খলা তথা গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের জন্য স্ব-স্ব পদ বা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবে। তবে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন শাখার অনুমোদন প্রয়োজন হবে এবং এ েেত্র সংশ্লিষ্ট শাখার সাধারণ সভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। ঊর্ধ্বতন শাখা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে তার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট শাখাকে জানাবে, অন্যথায় সিদ্ধান্তের সাথে একমত বলে গণ্য হবে।’ এই অনুচ্ছেদ অনুসারেই দলে লতিফ সিদ্দিকীর প্রাথমিক সদস্যপদ স্থগিত করে তাকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের ওই নেতা জানান। লতিফকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, যেহেতু তিনি ‘স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে স্বপ্রণোদিতভাবে সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র লংঘন করেছেন’ সেহেতু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প থেকে গভীর নিন্দা জানানো হয়েছে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে প্রবাসী টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে মন্তব্য করার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘স্পষ্টভাষী ও আত্মম্ভরী’ হিসেবে পরিচিত লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে বাংলাদেশে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। এরপর বিভিন্ন জেলায় তার বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা হয়। তার বিচার চেয়ে আন্দোলনের হুমকি দেয় বিভিন্ন ইসলামি দল ও বিএনপি। এমনকি নিজের দলেও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে নির্বাচিত চারবারের এই সংসদ সদস্য। তারই ধারাবাহিকতায় গত রোববার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের প্রজ্ঞাপন জারি এবং দলের সভাপতিমণ্ডলির পদ থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে পাঁচ বছর দাপটের সাথে পালন করেন। এবার ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকারে পেয়েছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে এক বছর না পেরোতেই তাকে বিদায় নিতে হলো।
স্পিকার দেশে ফিরলেই লতিফের এমপি পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত : চিফ হুইপ
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী দেশে ফেরার পর আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর এমপি পদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। গতকাল জাতীয় সংসদের মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। এ সময় হুইপ আতিউর রহমান আতিক, ইকবালুর রহিম, মাহাবুব আরা গিনি, জাহিদ আহসান রাসেল উপস্থিত ছিলেন। আ স ম ফিরোজ বলেন, তার (লতিফের) এমপি পদ থাকবে কি থাকবে না, এ বিষয়ে যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই, তাই স্পিকার দেশে ফিরে আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) নির্বাচনে প্রথম বাঙালি চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। সিপিএ চেয়ারপারসন নির্বাচিত হওয়ায় তাকে সংবর্ধনা দেবে জাতীয় সংসদ। এ নিয়ে এক প্রস্তুতি সভা শেষে দুপুরে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলেন চিফ হুইপ। তিনি জানান, আগামী ২১ অক্টোবর দেশে ফিরবেন স্পিকার। আর ২২ অক্টোবর সংসদের দণি প্লাজায় সংবর্ধনা দেয়া হবে স্পিকারকে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভাপতিত্ব করবেন ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া। স্পিকারকে সিপিএর চেয়ারপারসন পদে সমর্থন দেয়ায় শ্রীলঙ্কা ও ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিফ হুইপ বলেন, এর মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদের মর্যাদা বিশ্বে আরো উজ্জ্বল হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.