পিয়াস করিম: বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষণকালীন নক্ষত্র by ড. মাহফুজ পারভেজ

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের ঝাপসা চিত্র সংশ্লিষ্টদের অজানা-অদেখা নয়। গড় ও মধ্যমানের মেধার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে সব কিছু। গতানুগতিক ধারায় ভাসছে সবাই। দল বা ব্যক্তির লেজুড় বেশির ভাগ মানুষ। কারও ছায়ায় বা পক্ষপুটে বেঁচে থাকাই এখন এদেশে আদর্শ ও নিরাপদ। বেশির ভাগই কোন কোন পাণ্ডা বা মোড়লের অধীনে “ঘেঁটুপুত্র কমলা”। রাজনীতির মতোই সংস্কৃতি, শিক্ষা বা বুদ্ধির জগৎ আচ্ছন্ন করে আছে দানবের মতো গডফাদারগণ। এমন পরিস্থিতিতে সাহস করে নিজের বিশ্বাস বা চিন্তার আলোকে কথা বলা এক বিরাট বিপদের বিষয়। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা মহল বা দলের বাইরে কিছু বলা বা করা হলেই এদেশে তীব্র আক্রমণ নেমে আসে। মধ্যপন্থা বা বিকল্প কথা বা কারও পক্ষে কিছু বলা না হলেই সমালোচনার ঝড় এসে সব কিছু তছনছ করে দেয় ক্ষমতা বা ক্ষমতার বাইরের মাফিয়াদের কাছ থেকে। বুদ্ধিবৃত্তিও এখানে অসার কর্ম মাত্র। কর্তৃপক্ষের জন্য এ দেশে চাই দাসসুলভ জনশক্তি, কর্মী ও সমর্থক; কদাচ ন্যায্য সমালোচক নয়। এমনই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে ক্ষণকালের নক্ষত্রের মতো এলেন এবং চলে গেলেন প্রফেসর ড. পিয়াস করিম। সাহস, যুক্তি, বক্তব্যের স্পষ্টতায় প্রচণ্ড বিরূপ পরিস্থিতিতে তিনি একাকী দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন ভিন্নমতের যুক্তিনিষ্ঠ আলোয়। সম্মান ও শ্রদ্ধায় তিনি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বহুত্ববাদী  গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। নিজের মত ধারণ করে প্রবল বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক ও  আলোচনা করেছেন। যে কোন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে একধারা বা অতিসাধারণকৃত পক্ষ বা বিপক্ষের উগ্রতা বা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বাইরে নানা সম্ভাব্য বিকল্পের কথা বলেছেন। মানুষকে সঙ্কট থেকে বের হওয়ার আরও অনেকগুলো পথের দিকে যেতে ইঙ্গিত করেছেন। একজন পণ্ডিত, ভাবুক, চিন্তাবিদের বিশ্বজনীন দায়িত্বের প্রতিই ছিল তার অনুরাগ ও মনোযোগ। কখনও কখনও তার বক্তব্যকে কোন কোন দলের পক্ষে বা কাছাকাছি মনে হয়েছে। কিংবা তার বক্তব্যে কেউ কেউ লাভবান হয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনওই দলীয় হননি। নিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিকতাই তাঁর একমাত্র ও শেষ পরিচয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ হিসেবে জ্ঞানের বা যুক্তির বা বুদ্ধির আনুগত্যই ছিল তার কাছে কাম্য। গণতন্ত্র, মানবমুক্তি, প্রগতি, বহুত্ববাদকে যুক্তির সঙ্গে, তত্ত্ব ও তথ্যের সঙ্গে উপস্থাপন করাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের অজ্ঞতা, কূপমণ্ডূকতা, একদেশদর্শিতার বিদ্যমান সংস্কৃতিতে তিনি ছিলেন বিরাট এক ব্যতিক্রম। তাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করাও অনেক সময় নিম্ন মেধার দলদাসদের পক্ষে সব সময় সম্ভব। অনেকেই তাকে পুরোপুরি বুঝতেও পারেনি কিংবা ভুল বুঝেছে। তারপরও অতি স্বল্প সময়ে তিনি জয় করেছিলেন বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষের হৃদয়। মনোটনোস, স্বাদহীন, দল ও চেহারা দেখানো কর্কশভাষী, যুক্তিহীন টিভি আলোচকদের সামনে তিনি ছিলেন বিরল ব্যতিক্রম। দর্শক-শ্রোতার মনোযোগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। তার এবং তার মতো মানুষের উপস্থিতি বাংলাদেশে যত বাড়বে ততই এদেশের চিন্তার বৈকল্য দূরীকরণ সহজ ও ত্বরান্বিত হবে। দল-উন্মাদনা ও ব্যক্তি-পূজার বাইরে যুক্তি-চর্চার মাধ্যমে অর্জিত আধুনিক ব্যক্তি-অধিকার ও স্বাতন্ত্র্যের জায়গাটি প্রশস্ত হবে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, আইনের প্রকৃত শাসন ও গণতান্ত্রিক সুশাসনের বাংলাদেশের পক্ষেই তিনি তার কর্ম ও চেতনার সকল শক্তি ও সামর্থ্য ব্যয় করেছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে এসে এ ধরনের সর্বজনীন, মানবিক কল্যাণকর উদ্যোগ সবাই নিতে পারেন না। তিনি সে কাজ ও উদ্যোগটিই একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে যথাযথভাবে নিয়েছিলেন। এটাই তার জীবনের প্রধান সাফল্য। যদিও তার স্বপ্ন ও সাধ এখনই বাস্তবায়িত হয় নি এবং তার সংগ্রাম আরও অনেক দিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারায় প্রকৃত গণতন্ত্রায়নের স্বার্থে চলতে থাকবে, সেহেতু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চিন্তা-আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসচর্চার ধারা ও ইতিহাসে তিনি আরও অনেক দিন প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী চিন্তার আকাশে ক্ষণকালের নক্ষত্ররূপে আলোকপ্রভা বিচ্ছুরণ করতে থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.