রানা প্লাজা-তহবিল আছে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে না by আলী ইদরিস

এক বছর তিন মাস পূর্বে ১৪ই এপ্রিল ২০১৩ তারিখে সংঘটিত দেশের পোশাক শিল্পের সবচে’ বড় ও সবচে’ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ১,১৩৬ জন মারা যায় এবং প্রায় ৩,০০০ শ্রমিক আংশিক বা চিরতরে পঙ্গু হয়। এ দুর্ঘটনা দেশের তথা পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই এ বদনাম ঘুচাতে  যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোষীদের বিচার সম্পন্ন করে এবং মৃত ও আহতদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা উচিত ছিল। কিন্তু আজ ১৫ মাস পার হতে চললো এখনও বিচার শেষ হয়নি। মূল অভিযুক্ত ব্যক্তি, ভাগ্যবান শিল্পপতি রানাকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয়া হয়েছিল। মিডিয়া ও সুশীল সমাজের হৈচৈ দেখে অবশেষে রানার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন কতদিনে বিচার শেষ হয় সেটা দেখার বিষয়। রানা প্লাজা ধসে দোষীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। প্রথমত দেশের তথা সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা, দ্বিতীয়ত দোষীদের শাস্তি হলে পোশাক শিল্পের মালিকরা শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে আরও সতর্ক হতো। তৃতীয়ত, মৃতের জন্য  সন্তান হারা মা, স্বামী হারা স্ত্রী, স্ত্রীহারা স্বামী, সহোদর ও আত্মীয়দের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হতো। ক্ষতিপূরণ প্রদানে বিলম্বের জন্য এ দুর্ঘটনার ভুক্তভোগীরা অর্থাভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। আইএলও নেতৃত্বাধীন রানা প্লাজা এরেঞ্জম্যান্ট কো-অরডিনেশন কমিটির তহবিলে ১৪১ কোটি টাকা এ যাবত জমা পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে জনসাধারণের দানকৃত ১২৭ কোটি থেকে ২২ কোটি খরচ করার পর ১০৫ কোটি টাকা জমা আছে। এদিকে বৃটিশ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ২৯ ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে ট্রাস্ট ফান্ডে ক্ষতিপূরণ জমা দেয়ার কথা থাকলেও ১৬ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান কোন অর্থ দেয়নি, বাকিরা ৪ঠা জুলাই পর্যন্ত ১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার অর্থাৎ ১৪১.৬ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। ক্রেতাদের মধ্যে একমাত্র আয়ারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান প্রাইমার্ক ৬৩৯ জন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিককে ৯ মাসের বেতন দিয়েছে এবং রানা প্লাজার দ্বিতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটম শ্রমিকদের জন্য ৯০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ জমা দিয়েছে। মোট ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজন নাকি ৩২০ কোটি টাকা। কো-অর্ডিনেশন কমিটির তহবিলে ১৪১ কোটি ও প্রধানমন্ত্রীর তহিবলে ১০৫ কোটি ও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা ১৪১.৬ কোটির মোট যোগফল দাড়ায় ৩৮৭ কোটি টাকা। তাহলে আমার অংক কষায় ভুল না হয়ে থাকলে ফান্ডের অভাব নেই। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল বাদ দিলে এখানে কাজ করছে আরও চারটি কমিটি, আইএলওর নেতৃত্বাধীন কো-অর্ডিনেশন কমিটি, রানা প্ল্লাজা ডনরস ট্রাস্ট ফান্ড, সাভার সেনানিবাসে রানা প্লাজা ক্লেইমস এডমিনিস্ট্রেশন কমিটি এবং মাননীয় হাইকোর্ট কর্তৃক গঠিত উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি যারা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করবেন। শেষোক্ত কমিটিতে আবার উপ-কমিটিও আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সাভার ক্যান্টনম্যান্টের ক্লেইমস এডমিনিস্ট্রেশন কমিটির কাজ এখনও অনেক বাকি। হতাহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের স্বজনরা এখানে গিয়ে নির্দিষ্ট ক্লেইম ফরম পূরণ করেন যা প্রাথমিকভাবে যাচাই করে উত্তরাধিকারী বা স্বজনের নামে একটি ব্যাংক হিসাব  খুলে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২,৭৬৩ জন হতাহতের স্বজনদের ক্লেইম ফরম পূরণ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ৬৬০ জন নিহত। তাহলে নিহতের মধ্যে আরও বাকি আছে ৪৭৬ জন এবং আহত, পঙ্গুদের মধ্যে বাকি আছে অনুমানিক আরও ৯০০ জন। ১৫ মাসে যদি এতটুকু কাজ হয়ে থাকে তাহলে অবশিষ্ট কাজ কবে শেষ হবে, সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। দাবি ফরম পূরণ করে প্রকৃত দাবিদারদের তালিকা তৈরির কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালিকায় উল্লিখিত মৃত, আহত, পঙ্গু ও নিখোঁজ শ্রমিকদের শ্রেণীওয়ারী সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই বিদ্যমান তহবিল বরাদ্দ ও বিতরণ করা উচিত। এ তালিকাই যদি চূড়ান্ত করা না হলো, তাহলে ক্ষতিপূরণের হার, পরিমাণ ইত্যাদি নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অনেক মৃত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের অশিক্ষিত স্বজনরা হয়তো ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয়। তাই তারা সেনানিবাসের কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে ফরম পূরণ করতে পারছে না। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত নিয়োগকর্তা, বিজিএমইএ উদ্ধারকারী সেনাবাহিনী, দমকল বিভাগ, আশপাশের বাড়িওয়ালা, এদের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য ঠিকানায় সার্ভে টিম পাঠিয়ে মৃত ও নিখোঁজদের স্বজনদের নাম-ঠিকানা বের করা। নইলে অশনাক্ত মৃত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের উত্তরাধিকারীরা ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হবে। এদের খুঁজে বের করা সরকারের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দেয়া উচিত। দাবিদারদের তালিকা চূড়ান্ত কারাটাই এখন প্রধান ও একমাত্র কাজ বলে আমি মনে করি। এরপরই সব কমিটির সুপারিশ নিয়ে একসঙ্গে বসে বিদ্যমান তহবিলের পরিমাণ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ করা উচিত। ভবিষ্যতে আরও তহবিল আসতে পারে, সেটা ক্রেতাদের কাছ থেকে হোক বা বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর দোষীদের কাছ থেকে হোক। সেটার জন্য অপেক্ষা না করে বিদ্যমান তহবিল থেকে নির্ধারিত হারে অতি সত্বর ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত স্বজনরা যারা তিন বেলা আহারের জন্য হতাহত শ্রমিকদের আয়ের ওপর নির্ভর করতো, তাদের উপোস করা বন্ধ হবে।

No comments

Powered by Blogger.