ঢাকা পরিণত হয়েছে দুর্ভোগের নগরীতে

যানজট এড়াতে রমজানের শুরুতেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সকাল থেকেই ঢাকা রাস্তা পরিণত হচ্ছে যানবাহনের সারিতে। দীর্ঘ এই যানজটে ঢাকা পরিণত হয়েছে দুর্ভোগের নগরীতে। আধ ঘণ্টা কিংবা এক ঘণ্টা দূরত্বের রাস্তা তিন থেকে চার ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হচ্ছে কর্মজীবী নগরবাসীকে। শুধু তাই নয়, প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে অসহনীয় এ যানজট। গতকালও রাজধানীর বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, প্রেস ক্লাব, হাকাকোর্ট, পল্টন, গুলিস্তান, মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক দিনভর সর্বত্র ছিল চিত্র একই। সকাল থেকে শুরু হয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে যানজট থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। চলছে নগরবাসীর ঈদ-উল ফিতরের কেনাকাটা। মধ্যরাত পর্যন্ত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিপণি বিতানগুলোতে কোনাকাটা চলছে। রোজার আগে যানজট নিয়ন্ত্রণে সরকারের তরফে অনেক উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপই কাজে আসছে না। ফলে এক প্রকার থমকে গেছে নগরবাসীর জীবনযাত্রা। রাস্তার গণপরিবহনেই কেটে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টার বেশির ভাগ সময়। গতকাল দিনভর বনানী সিগন্যাল থেকে ফার্মগেট আসতে সময় লেগেছে ক্ষেত্র বিশেষে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা। কখনও বেশিও লেগেছে। দুপুর ১২টায় মহাখালী উড়াল সড়কের দুপাশে শ’ শ’ যানবাহনকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আবদুল্লাহপুর উত্তরা টু গুলিস্তান রুটের বিআরটিসি (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন) পরিবহনের চালক ইব্রাহিম মিয়া বলেন, সকাল ১১টায় উত্তরা থেকে রওনা হয়ে মহাখালী আসতেই চলে গেছে দেড় ঘণ্টা। একই রুটের ৩ নম্বর গাড়ির চালক সোলেমান জানান, গুলিস্তান থেকে সকাল ১০টায় রওনা হয়ে ফার্মগেট আসতেই বেলা সাড়ে ১১টা বেজে গেছে। এতে করে উত্তরা রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা ফার্মগেটে অপেক্ষা করেও কোন গাড়ি পাননি। দুপুরে সরজমিন ফার্মগেট এলাকায় দেখা গেছে, প্রখর রোদে প্রচ- গরমে শ’ শ’, রোজাদার গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু আকাঙিক্ষত গাড়ি অনেকেই পাননি। একেকটি বাস এসে দাঁড়াতেই হুড়মুড় উঠতে চাইছে এক সঙ্গে অনেক মানুষ। পুরুষরা কোনমতে তা পারলেও বিপাকে পড়েছিলেন নারী ও শিশুরা। গৃহিণী সালমা খাতুন বলেন, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ১১টা থেকে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোন গাড়ি পাননি। হেঁটে গন্তব্যে যাবেন সে উপায় নেই। ফার্মগেট এলাকায় দেখা গেছে, মিরপুর থেকে আসা গাড়িগুলো বারবার খামারবাড়ি সিগন্যালে আটকা পড়ায় যাত্রীদের অনেকে পায়ে হেঁটে বাংলামোটর, শাহবাগসহ বিভিন্ন গন্তব্যে রওনা হয়েছেন। মিরপুর সদরঘাট রুটের ইউনাইটেড পরিবহনের লাইনম্যান জয়নাল বলেন, খামারবাড়ি সিগন্যালে একেক সময় আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এছাড়া ফার্মগেট থেকে সদরঘাট গুলিস্তানগামী বাসগুলো এক থেকে দু’ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে গন্তব্যে পৌঁছতে। মিরপুর ১ নম্বর থেকে সদরঘাটগামী তানজিল পরিবহনের দুই যাত্রী শাহাবুদ্দিন ও হামিদ মিয়া জানান, সকাল ১১টায় মিরপুর ১ নম্বর থেকে বাসে উঠেছিলেন। প্রায় দু’ঘণ্টায় ফার্মগেট পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন। কাওরানবাজার পান্থপথ সিগন্যালে দেখা গেছে রাস্তার দু’পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে শ’ শ’ গাড়ি। ফার্মগেট থেকে পান্থপথ সিগন্যাল এই এতটুকুন পথ আসতে সময় লেগেছে আধঘণ্টা। গতকাল রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজটের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে। যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী রুটে চলাচলকারী ২১/৮ নম্বর বাসের চালক মিজান জানান, দয়াগঞ্জ আটকে ছিলেন আধ ঘণ্টা, পল্টনে আরও ৪০ মিনিট, এই যানজট পার হয়ে শাহবাগ শিশুপার্ক সিগন্যালে আসতে পেরিয়ে গেছে আরও একঘণ্টা। এভাবে যদি রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায় তাহলে গাড়ির ব্যবসা লাটে ওঠবে।
দুপুর তিনটায় শাহবাগ এলাকায় দেখা গেছে ফার্মগেটমুখী শ’ শ’ গাড়ি শাহবাগ শিশুপার্ক এলাকায় ঠায় দাঁড়িয়ে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। একে তো প্রচ- গরম, তারওপর গাড়িতে ঘণ্টার পর বসে থাকা। তাতে সহ্যের মাত্র ছাড়িয়ে যায় অনেকের। এসময় গরমে ক্লান্ত হয়ে অনেকে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েন। শাহবাগ পার হয়েও স্বস্তি ছিল না। পান্থপথ সিগন্যালে ছিল না কোন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ রতন জানান, সকাল থেকেই এই অবস্থা। কোনমতেই তাল সামলাতে পারছিনা। কোন দিকেই নিয়ন্ত্রণ রক্ষা কারা যাচ্ছে না। এদিকে, বহুল আলোচিত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের কারণে মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক এলাকায় যানজটের তীব্রতা আগের চেয়ে বেড়েছে। মগবাজার এলাকার কয়েকজন এলাকাবাসি জানান, এই এলাকার যানজট ছিল নিত্য। এখন ফ্লাইওভার নির্মাণের শুরু থেকেই রাস্তায় খানাখন্দ। তাতে দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। বৃষ্টি হলে তো আর রক্ষা নেই। গাড়িগুলোর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আর কিছুই করার থাকে না। এই এলাকার আহসানুল হক নামের একজন ব্যাংকার ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে বলেন তীব্র যানজটে আমরা অতীষ্ট। ভোরে বেরিয়েও সময়মতো অফিস করতে পারি না। অন্যান্য দিন একেক সময়ে বাড়ি ফিরলেও রমজানে সবাই সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে চান। আর একই সময়ে অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে এই সড়কগুলোতে যানজট এখন তীব্র। এদিকে, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরার বেশির ভাগ স্কুলগুলোতে চলছে রমজানের ছুটি। কিন্তু তাতে যানজট থেকে স্বস্তি মেলেনি এতটুকু। এসব এলাকায় বিপনি বিতান থাকায় রিকশা ও প্রাভেটকার চলাচল করে বেশি। যে কারণে যানজটও ছিল বেশি। দুপুরে পান্থপথ সিগন্যালে দেখা যায় বসুন্ধরা শপিংমল মুখী শ’ শ’ গাড়ি ঠায় দাড়িয়ে। প্রাইভেটকার যাত্রী শ্যামল ভৌমিক বলেন, রমজানের শুরু থেকেই যানজট এখানকার নিত্যসঙ্গী। রাস্তার পাশের খোঁড়াখুঁড়ি দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে গন্তব্যে পৌঁছতে গণপরিবহনের অপেক্ষায় থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সরকারি অফিস-আদালতগুলো নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয়ে আবার নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি। এ কারণে বেলা যত গড়ায় যানজটের মাত্রা ততই অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। ইফতারের আগ মুহূর্তে এসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। বিকাল পাঁচটায় ফার্মগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইফতারের আগে ক্লান্ত অবসন্ন শ’ শ’ কর্মজীবী মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। এদের সবাই বাসায় গিয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে ইফতারে শামিল হওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু কাঙিক্ষত গণপরিবহন না পাওয়ায় অনেককেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিংবা ফুটপাতে বসে ইফতার করতে দেখা যায়। ফার্মগেটের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের সুপারভাইজার আল-আমিন মিয়া জানান, প্রেস ক্লাব শাহবাগের দিক থেকে গাড়িগুলো একেবারেই আসছে না। এ কারণে  যাত্রীদের প্রচ- গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেকেই ফুটপাতেই ইফতার সেরেছেন বলে জানান তিনি। ফার্মগেটে কথা হয় খিলক্ষেত নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা শরীফ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাসায় ফেরার জন্য উত্তরা রুটের বাসের জন্য অপেক্ষায় আছেন। বাসায় স্ত্রী সন্তানরা অপেক্ষায় আছে। যানজটের ভয়ে অনেক আগেই রওনা হয়েছিলেন, কিন্তু বিকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত কাঙিক্ষত বাস পাননি বলে জানান তিনি। সরজমিনে ঘুরে দেখা যায় যানজট থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য বিভিন্ন রুটের গণপরিবহনগুলো আইন লঙ্ঘন করে রুট পরিবর্তন করে রাস্তার এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে যাচ্ছে। বাংলামোটর, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট মাজার এলাকায় এ চিত্র বেশি চোখে পড়েছে। তবে লাভ হয়নি তাতেও। বরং তা যানজটের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.