কর্নেল জিয়ার জবানিতে -ভিডিওচিত্র মোবাইল কথোপকথন

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের তিন সদস্য জড়িত থাকার স্বপক্ষে বিস্তারিত জানালেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল জিয়াউল আহসান। তদন্ত কমিটির সদস্যদের দেখালেন মেজর আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও চিত্র। শোনালেন বরখাস্তকৃত ও সাত খুনের ঘটনায় জড়িত তিন কর্মকর্তার মধ্যে মোবাইলে কথোপকথন। গতকাল তার কাছ থেকে সাক্ষ্য নেয় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি। ভিডিও চিত্র দেখা, মোবাইল কথোপকথন শোনা এবং সার্বিক ঘটনা জিয়াউলের মুখ থেকে শুনতে তিন ঘণ্টা ৫০ মিনিট লেগে যায়। এরপর তদন্ত কমিটির প্রধান এবং সাক্ষ্যদানকারী র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য দেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কর্নেল জিয়া প্রথমেই সাত খুনের ঘটনা নিজে অবহিত হওয়ার সময়কাল, কার মারফত জানলেন- সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানান তদন্ত কমিটিকে। তিনি বলেন, ২৭শে এপ্রিল দুপুরের কিছু পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় মারফত সাত জনকে অপহরণের বিষয়টি জানতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে জানাতে বলা হয়। এরপর খোঁজ নিয়ে র‌্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়টি আঁচ করতে পারি। পরক্ষণেই সাত গুমের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের জানাই। এরপরই র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে র‌্যাব ১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং  লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানার মোবাইল ফোনের কথোপকথন উদ্ধার করা হয়। ওই কথোপকথনে সাত জনকে গুম ও পরবর্তীতে হত্যার বিষয়টি প্রকাশ পায়। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জিয়া জানান, তিন কর্মকর্তা জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর ২৮শে এপ্রিল ভোর পাঁচটায় মেজর আরিফকে র‌্যাব সদর দপ্তরে ডেকে পাঠাই। যথাসময়ে তিনি হাজির হন। এরপরই তদন্ত কমিটির সদস্যদের মেজর আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও চিত্রটি দেখানো হয়। ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, মেজর আরিফ প্রথম দিকে বার বার ঘটনার বিষয়ে নিজের সংশ্লিষ্টতা এড়াতে চান। কর্নেল জিয়া ওই সময় বলেন, এত বড় একটি ঘটনা ঘটার পরও র‌্যাব সদর দপ্তরকে তুমি কেন জানাও নি। তুমি জানো এখনই আমি তোমাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারি। পরক্ষণেই আরিফসহ কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ আছে বলা হলে কিছুটা ভড়কে যান। কিছুটা সময় নিয়ে এরপর আরিফ বলেন, সিও স্যারের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া এ বিষয়ে আমি কিছু জানাতে পারবো না। তখন জিজ্ঞাসাবাদ রুম থেকেই সিওকে ফোন করা হয়। সিও বলার পর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ করে মেজর আরিফ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, একটি জাতীয় দৈনিকের উদ্ধৃতি দিয়ে নূর হোসেন কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়েও তদন্ত কমিটিকে নিজের বক্তব্য দেন কর্নেল জিয়া। র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেয়ার পর কমিটির প্রধান ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাজাহান আলী মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, সাত খুনের ঘটনায় তিন র‌্যাব কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছে। এ জন্য র‌্যাবের অপারেশনাল হেড হিসেবে তার (জিয়াউল আহসানের) বক্তব্য নেয়া হয়েছে। তার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউলের কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছিল কিনা- এমন প্রশ্নে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, এ বিষয়ে পরে জানতে পারবেন। জিয়াউলকে ব্যক্তিগতভাবে নয়, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে ডাকা হয়েছে। তদন্ত কমিটি এ পর্যন্ত ৩৫০ ব্যক্তির বক্তব্য নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে কিনা জানতে চাইলে কমিটির প্রধান বলেন, এসব বিষয় সময়মতো জানতে পারবেন। তবে ঘটনার তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে জানিয়ে শাহজাহান মোল্লা বলেন, সাড়ে তিন শ’ মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আর কাকে কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তা তদন্ত কমিটি বসে ঠিক করবে। তদন্ত কমিটিতে সাক্ষ্য শেষে সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কর্নেল জিয়া বলেন, তারা (তদন্ত কমিটি) যে সব বিষয় জানার প্রয়োজন মনে করেছে, সেগুলো জানিয়েছি। তারা যে প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর দিয়েছি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম গত ২৭শে এপ্রিল অপহৃত হন। তিন দিন পর গত ৩০শে এপ্রিল একে একে ছয়জনের এবং পরদিন ১লা মে আরেকজনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। অপহরণের ঘটনার পরপরই নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়। নূর হোসেন র‌্যাবকে ছয় কোটি টাকা দিয়ে সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন বলে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন। শুরুতে অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিলেও অপহৃতদের লাশ উদ্ধারের পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান নূর হোসেন। পরে দুই সহযোগীসহ তিনি পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হন। র‌্যাবের বিরুদ্ধে হত্যাকা-ে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকা-ে নিজেদের দোষ স্বীকার করে ইতিমধ্যে আদালতে তিন র‌্যাব কর্মকর্তা জবানবন্দিও দিয়েছেন। তাদের তিনজনকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। এর আগে সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশে গত ৭ই মে এই তদন্ত কমিটি করে সরকার। এ  কমিটি কয়েক দফায় নারায়ণগঞ্জ সার্কিট হাউসে ও সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রেস্ট হাউসে গণশুনানি করে। কমিটি ওই সাতজনের লাশ উদ্ধারের স্থান, নারায়ণগঞ্জ র‌্যাব-১১ এর ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ও ক্যাম্প অফিস পরিদর্শন করে। এখন চলছে সাক্ষ্য নেয়ার পালা।

No comments

Powered by Blogger.