মানবাধিকার পরিস্থিতি

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদনে গত ছয় মাসের মানবাধিকার লংঘনের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা উদ্বেগজনক। এতে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে দেশে ১০৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছে, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের স্বজনদের গুলি করে হত্যা করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ১০৮ ব্যক্তির মধ্যে পুলিশের হাতে ৩৯, র‌্যাবের হাতে ১৪, যৌথবাহিনীর হাতে ৮, র‌্যাব-বিজিবির হাতে ২ ও কোস্টগার্ডের হাতে ৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে কথিত অপরাধীর সংখ্যা ৪৬। অধিকারের আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮৭০ ব্যক্তিকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের হার কমছে তো নাই-ই, বরং বাড়ছে। শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই নয়, দেশে নানাভাবে মানবাধিকার লংঘিত হয়ে চলেছে। অপহরণ-গুম-খুন, সংখ্যালঘু হত্যা ও নির্যাতন, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালীন হত্যা, কোনো বিশেষ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলজনিত হত্যা ইত্যাদি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে দেশে।
বস্তুত কোনো অপরাধের ঘটনার পর তার কূলকিনারা করতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একদিকে, অন্যদিকে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও গোপন থাকছে না। খোদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও এমন অভিযোগ তুলেছিলেন। আইন-শৃংখলা ও মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তারাই যদি অপরাধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে বাধ্য। প্রকৃতপক্ষে আইন-শৃংখলা ব্যবস্থার যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া এবং আইন-শৃংখলা রক্ষার নামে আইন-শৃংখলা বাহিনীর অপতৎপরতা বন্ধে সুনিশ্চিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। র‌্যাব-পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করার কারণে একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও এক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এ কমিশনের চেয়ারম্যানকে আমরা মাঝে-মধ্যেই অপরাধ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার সব অনুযোগ, উৎকণ্ঠা অরণ্য রোদনে পর্যবসিত হয়। দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা ইতিপূর্বে দেশের মানবাধিকার ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সরকার বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি।

বর্তমান বাস্তবতায় অধিকারের প্রতিবেদনটি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। মানবাধিকার পরিস্থিতির বর্তমান চিত্রের জন্য সরকার বহুলাংশে দায়ী। সুতরাং পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর দায় সরকারেরই এবং তা করতেই হবে। এটা এমন কোনো কঠিন কাজও নয়। সরকারের তৎপরতায় জঙ্গি-উৎপাত সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে। অপহরণ-গুম-হত্যার ব্যাপারেও সরকার যদি আন্তরিক হয়, তাহলে এ সংকটও কাটানো সম্ভব। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ উঠেছে, সে ব্যাপারে সরকারকে নিতে হবে কঠোর অবস্থান। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় র‌্যাবের তিন সদস্যকে যেভাবে আইনের আওতায় আনা হয়েছে, প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই একই ধরনের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক মাসের বিরতির পর রমজানে র‌্যাব আবারও নিয়মিত টহলে নেমেছে। নারায়ণঞ্জের ঘটনার পর টহল কার্যক্রম থেকে র‌্যাবকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। র‌্যাবের টহল কার্যক্রমের বিরোধিতা করার কিছু নেই। তবে র‌্যাবের হাইকমান্ড ও প্রত্যেক সদস্যকেই খেয়াল রাখতে হবে, অতীতে তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, এখন থেকে তেমনটা যেন আর না ওঠে। র‌্যাবের হৃত ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে হবে র‌্যাবকেই। জনগণেরও উচিত হবে আইন-শৃংখলা রক্ষা ও অপরাধ দমনে র‌্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃংখলা বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করা।

No comments

Powered by Blogger.