সুন্দর এক প্রাচীন শহর

সমুদ্রের গভীরে কয়েক হাজার ফুট নিচে সে এক অদ্ভুত জগত! সাজানো-গোছানো সুন্দর এক শহর। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করতে করতে একদল অভিযাত্রী একদিন পৌঁছে গেলেন সেই শহরে। সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে নাম না জানা অদ্ভুত সব প্রাণী, মাছ, জলজ উদ্ভিদ, আর তাদেরই পাশাপাশি বহাল তবিয়তে বসবাস করছে মানুষ। তাদের বাড়িঘর রয়েছে। আছে খেলাধুলোর ব্যবস্থাও। ডাঙার মানুষ কিন্তু এতদিন টেরই পায়নি যে, জলের নিচে রয়েছে আশ্চর্য এক সভ্যতা! এ পর্যন্ত পড়ে আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার আগেই জানিয়ে দেয়া ভালো, কল্পনার ডানায় ভর করে লেখা বিখ্যাত এক কল্পবিজ্ঞানের গল্পের অংশ এটি। ১৯২৯ সালে শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল লিখেছিলেন, ‘ম্যারাকট ডিপ’ নামে এ সায়েন্স ফ্যানটাসি। তার গল্পে ছিল হারিয়ে যাওয়া এক শহর ‘আটলান্টিস’-এর কথা।
কোথায় ছিল আটলান্টিস
পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত সমাধান না হওয়া যত রহস্য আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল এ আটলান্টিস। যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৩৫৫ বছর আগে আটলান্টিসের কথা প্রথম জানিয়েছিলেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। আজ থেকে প্রায় দশ-বারো হাজার বছর আগে অতলান্তিক মহাসাগরের কাছে অবস্থিত এই দেশটিতে নাকি ছিল অত্যন্ত উন্নত এক সভ্যতা। অনেকের বিশ্বাস, গ্রিক দ্বীপ ক্রিটের কাছাকাছি ছিল আটলান্টিস।
এক ভয়ংকর ভূমিকম্প আর প্রবল জলোচ্ছ্বাসের ফলে এক রাতের মধ্যে অতলান্তিক মহাসাগরের নিচে তলিয়ে যায় এ শহর। এ নিয়ে যে কত বই, গল্প, প্রবন্ধ লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তৈরি হয়েছে ‘আটলান্টিস : দ্য লস্ট কন্টিনেন্ট’, ‘আটলান্টিস : দ্য লস্ট এম্পায়ার’-এর মতো বেশ কয়েকটি সিনেমাও।
আশ্চর্য শহর
সে ছিল এক সব পেয়েছির দেশ। প্লেটোর কথা অনুযায়ী আটলান্টিস ছিল এক স্বর্গোদ্যান। অত্যন্ত উর্বর এখানকার মাটিতে ফলমূল, শাকসবজির কোনো অভাব ছিল না। মনমাতানো গন্ধে ভরা রঙ বেরঙের সুন্দর ফুলে ভরে থাকত সবুজ এ রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা। পাহাড়, সমুদ্র আর অরণ্যে ঘেরা অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভায় সমৃদ্ধ এ রাজ্যে সোনা, রুপো, তামা ইত্যাদি খনিজ সম্পদেরও কোনো অভাব ছিল না। সেচ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত। শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষের একেবারে চরম সীমায় পৌঁছেছিল সেই শহর। নানা ধরনের জীবজন্তু ছিল। ঘোড়া আর হাতিকে পোষ মানাত মানুষ। বিজ্ঞানে প্রচণ্ড উন্নত ছিল আটলান্টিস। ইঞ্জিনিয়াররা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। তাদের তৈরি বন্দর, প্রাসাদ, মন্দির, খাল এবং জাহাজ তৈরি বা মেরামতির ব্যবস্থা ইত্যাদিতে ছিল অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া। বিশেষ বিশেষ জায়গায় ঠাণ্ডা ও গরম জলের ঝরনার ব্যবস্থা ছিল। সুখে-শান্তিতে বসবাস করত মানুষজন।
আটলান্টিস রহস্য ভেদ করার জন্য বহু বছর আগে থেকেই পণ্ডিত ও গবেষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে আটলান্টিস বলে কোনো দেশের আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল না কোনোদিন। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন সত্যিই পৃথিবীর বুকে একসময় ছিল অত্যন্ত উন্নত এই সভ্যতা। তবে সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর খবর দিয়েছেন আমেরিকার একটি রিসার্চ টিমের মুখ্য গবেষক, কানেকটিকাটের হার্টফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রিচার্ড ফ্রিয়ান্ড। তারা নাকি জানতে পেরেছেন হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিসের সুলুকসন্ধান। তিনটি দেশের গবেষকদের একটি দল মাটি ভেদ করতে পারে এরকম অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে স্পেনের ‘দোনানিয়া ন্যাশনাল পার্ক’-এর মাটির নিচে খুঁজে পেয়েছেন ক্যানাল সিস্টেমের প্রমাণ। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি দেখে তাদের ধারণা হয়েছে, এই ন্যাশনাল পার্কের বিস্তীর্ণ জলাভূমির নিচে চাপা পড়ে আছে একটা আস্ত শহর, আর সেটা যে রহস্যে ঘেরা আটলান্টিসই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই তাদের। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জার্মান পদার্থবিদ রাইনার কুন বলেছেন, যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৮০০ থেকে ৫০০ বছর আগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আটলান্টিস। ফ্রিয়ান্ড বলেছেন, গবেষণা চলছে এবং খুব শিগগিরই হারিয়ে যাওয়া এ শহরের অস্তিত্বের যাবতীয় প্রমাণ পেশ করবেন তারা।
সত্যিই কি সমাধান হতে চলেছে আটলান্টিস রহস্য? হারিয়ে যাওয়া গার্ডেন অফ ইডেনের ধ্বংসাবশেষ কি শেষ পর্যন্ত খছুজে পাওয়া যাবে? যদি সত্যিই প্রাচীন এ সভ্যতার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়, তাহলে তা হবে মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, মিশর, ব্যাবিলন ইত্যাদির সভ্যতার চেয়ে অনেক পুরনো। আর তখন যে পৃথিবীর ইতিহাস আবার নতুন করে লিখতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

No comments

Powered by Blogger.