তাঁর আলো ও আগুন by মুহম্মদ নূরুল হুদা

একজন কবি সুদীর্ঘকাল বেঁচে থেকে হাজার কয়েক কবিতা লিখলেই যে বিরাট কবি হয়ে যাবেন, এমন নাও হতে পারে। বছর বিশ-একুশ মাত্র বেঁচে গোটা কয়েক অবিস্মরণীয় ও প্রাকদৃষ্টান্তরহিত কবিতা লিখেই কোনো কোনো কিশোর বা কৈশোরোত্তীর্ণ কবি অনন্তের সমানবয়সী হয়ে গেছেন। সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে প্রকৃত নতুন সৃষ্টি শনাক্ত করাটাই মূল কাজ। এই শনাক্তিকরণের প্রধান হাতিয়ার কবির স্বাতন্ত্র্যসূচক কাব্যভঙ্গি ও ভাষিক কাঠামো। কেবল সচেতন, শ্রমশীল ও মৌলিক কবিরাই এই কাজ করে থাকেন। তারা হয়তো খুব বেশি লেখেন না, কিন্তু যা লেখেন তাতে তারা নিজেদের অননুকরণীয় কৌশলে ফুটিয়ে তুলেন নিজেদের ‘ভেতরের আগুন’। এই ‘আগুন’ শিখা হয়ে জ্বলে, তবে অন্য কারো শিখা নয়, একান্তই নিজের শিখা। এই শিখা সহজে অন্য কারো শিখার সঙ্গে মেলেও না। সমালোচকের বিরূপ মন্তব্যের জবাব দিতে এমন একজন স্বশিখাধারী কবি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, ‘ভাষার খই/ তো ফুটয়েছেন অনেকেই,/ ও যদি ধরতে চায় ভেতরের আগুন/ মশাল না জ্বেলেই,/ ব্যাপারটা অতো সহজে বাতিল না-ই করলেন।’ (‘এক সমালোচককে’ : এখনো সময় আছে; ১৯৯৭)। এই কবি আর কেউ নন; তিনি বাংলাদেশের বদলপ্রবণ কাব্যভুবনের প্রবীণতম কারুকৃৎ কবি আবুল হেসেন। নব্বুই পার হয়েছেন বছর দুই আগেই। পরিমিত, প্রায়-নিশ্চিত পদক্ষেপে এগোচ্ছিলেন শতবর্ষের পথে। আমরা অপেক্ষা করছিলাম তার সৃষ্টিশীলতার শতবর্ষ উদ্যাপন করব তাকে সামনে রেখেই।

কিন্তু তিনি আমাদের নিশব্দ প্রতীক্ষাকে অগ্রাহ্য করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার ‘কবিতাসমগ্র’-র ফ্ল্যাপে সম্পাদক কবি মনজুরে মওলা যথার্থই লিখেছিলেন, ‘আমাদের প্রবীণতম তিনি। হয়তো নবীনতমও, কে বলতে পারে।’ প্রবীণতম বলার পরপরই তাকে ‘হয়তো নবীনতম’ বলার কারণটাও মূলত কাব্যিক। কেননা তিনি সময় ও প্রবণতার দিকে চোখ রেখে সত্তর বছরেরও অধিককাল ধরে সৃষ্টিশীল পঙ্ক্তিচয়নে বারবার পরিমিত পরিবর্তনের স্বাক্ষর রেখেছেন; অনেকটা সদ্য-প্রকাশিত নতুন কবির মতোই। ফলে সচেতন কাব্যচর্চার শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কবিতা লিখেছেন কিশোর কবির প্রতিশ্র“তি ও পরিণত কবির পরিশীলনকে সম্পৃক্ত করে। বয়সকে সৃষ্টিশীল কৌশলে পরাজিত করার এই দক্ষতা খুব কম কবিই আয়ত্ত করতে পারেন। এই দক্ষতাকেই আমরা বলতে চাই কবির সৃষ্টিশীলতার অন্যরকম ভেতর-আগুন। খুব কম কেউ তেমন দক্ষতার অধিকারী। আবুল হোসেন সেই বিরলপ্রজদেরই একজন।
সেই তিনিই, সেই বিরলপ্রজ বার্ধক্যজয়ীই, হঠাৎ করে শারীরিকভাবে তিরোহিত হলেন। পরিণত বয়সেই চলে গেলেন তিনি, তবু বলব, হঠাৎ করেই গেলেন। সুদীর্ঘ জীবনে কোনো কিছুতেই খুব তাড়াহুড়ো করেননি। বৈষয়িক জীবনটা যেমন যাপন করেছেন ছক কেটে কেটে, তেমনি সৃষ্টিশীলতার পথেও হেঁটেছেন ধীর পদবিন্যাসে, পরিকল্পিত কাঠামো ও পরিমিত চরণ-সজ্জায়। সৃষ্টিশীলতার কাছে পূর্ণ-সমর্পিত এই কবি তাই প্রার্থনা করেছেন (সম্ভবত স ষ্টার কাছে) : ‘কাকে কি দিচ্ছ আমি তা জানি না,/ জানতেও চাইব না।/ যাকে খুশি দিও সারা দুনিয়ার/ সোনাদানা বালাখানা/ আমার জন্যে রেখে দিও শুধু/ তোমার কলমখানা।’ এত সহজ এত স্বতঃস্ফূর্ত এত অকপট এত নিরাবেগ এত যুক্তিশীল কাব্যপ্রার্থনা দ্বিতীয়টি পড়েছি বলে মনে পড়ে না। এই অনায়াস নির্মিতি দীর্ঘ নিরীক্ষার ফল। তাঁর সেই সুনিরীক্ষিত পথ-চলা পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের জন্যে পরোক্ষ প্রেরণা হয়ে এসেছে। স্বীকার করি, আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি।
আমি তাকে দেখেছি বিশ শতকের ষাট দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে।
কিন্তু হৃদ্যতা বলতে যা বোঝায়, তা হয়েছে তারও প্রায় তিনদশক পরে। তখন আমি উপ-পরিচালক হিসেবে কাজ করছি বাংলা একাডেমির ভাষা ও সাহিত্য উপবিভাগে। একটা নিরাপদ ও সশ্রদ্ধ দূরত্বে থেকেছি বরাবর। কিন্তু যখনি কাছে গেছি তখনি শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়েছি এই পিতৃপ্রতিম কবি-অভিভাবকের প্রতি। বাংলাদেশের কবিতায় এই অভিভাবকত্ব তিনি বজায় রেখেছিলেন অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। তবে সরবে নয়, নীরবে; বলা যেতে পারে তর্করহিত সঙ্গোপনে। এর কারণও অবশ্য মানুষ ও কবি আবুল হোসেনের নান্দনিক নিসঙ্গতা, যা যে কোনো শুদ্ধাচারী স ষ্টার সচেতন অন্বেষণ। সেই সৃজনসম্মত অন্বেষণের একপর্যায়ে তিনি অনুবাদ করেছিলেন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন কালের কবিদের কিছু প্রিয় পঙ্ক্তি। সেগুলো একত্রিত করে বানিয়েছিলেন এক অত্যাশ্চর্য পাণ্ডুলিপি : ‘অন্যখেতের ফসল’। বাংলা একাডেমিতে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ উপবিভাগে এসেছিল সেই পাণ্ডুলিপি। ফলে মানুষ আবুল হেসেনের সঙ্গে সঙ্গে তার লেখার সঙ্গেও ব্যক্তিক পরিচিত লাভের সুযোগ পাই। এই পাণ্ডুলিপিটি গ্রন্থাকারে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে জুন ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে (শ্রাবণ ১৩৯৭)। এটি অনূদিত গ্রন্থ হলেও মৌলিক কবিতার মতো সুপাঠ্য ও উত্তীর্ণ। ইয়েটসের ‘কাঠবিড়ালি’ শীর্ষক ছোট্ট কবিতার পুনর্সৃষ্টি, এক কথায়, অনবদ্য : ‘আমার সঙ্গে খেলবি আয়/ দৌড়ে অমন পালাস কেন/ গাছ থেকে গাছে ডালপালায়?/ বন্দুক আছে আমার যেন,/ গুলি করে মেরে ফেলব তোরে,/ চেয়েছি যখন এইটুকুই/ মাথাটা চুলকে দেবো শুধুই।/তারপরে যাস দৌড়ে জোরে।’
এতেই অনুমিত হয় কত গভীর কত নৈর্ব্যক্তিক কাব্যবোধ ও পুনর্সৃষ্টির শক্তি নিয়ে এসেছিলেন এই কবি। প্রথম কাব্য ‘নব বসন্ত’ (১৯৪০, উৎসর্গ : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) থেকে শুরু করে সর্বশেষ ‘কালের খাতায়’ (২০০৮) শীর্ষক মাত্র আটটি (অগ্রন্থিত কবিতা বাদে) মৌলিক কাব্যে শব্দবিন্যাসে, পঙ্ক্তির বৈচিত্র্যায়নে, উচ্চারণের মৌলিকতায়, ভুয়োদর্শনে, ব্যঙ্গে, সরস সহজতায় তিনি যে কাব্যভুবন নির্মাণ করেছেন, তা তার সৃষ্টিসত্তার অনন্যতারই স্বাক্ষরবহ। একই সঙ্গে তা উত্তরকালের কবিতাসাধকের জন্য পাঠযোগ্য কাব্যভাষ্য। এ দেশের মাটি, মানুষ, সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি থেকে শুরু করে বিগত একশ’ শতাব্দীর বাঙালির ইতিহাসের প্রায় সব বিষয়কেই তিনি কোনো-না-কোনোভাবে ধারণ করেছেন তার কবিতায়। কিন্তু কখনও বক্তব্যকে তুলে ধরতে গিয়ে যেমন উচ্চকণ্ঠ হননি, তেমনি প্রতিপাদ্যকে গৌণ করে মেতে ওঠেননি অতিনান্দনিকতায়। তার বেশকিছু কবিতা আমার কাছে মনপ্রিয়তায় ঘুরে ঘুরে কথা কয়। যেমন ‘মেহেদীর জন্য’, ‘ডিএইচ রেলওয়ে’, কিংবা ‘তোমাকে নিয়েই যত খেলা’। এগুলো কাঠামোগতভাবেই একটার সঙ্গে অন্যটা মেরুর অবস্থানে, কিন্তু উচ্চারণের হার্দ্যতায় অনির্বচনীয় ও সমতলীয়।
তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার ধারার সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন তার পাঠসমৃদ্ধ বিশ্বকবিতার নানাকৌণিক প্রবণতাও। ফলে বাঙালি কবি হয়েও তিনি বিশ্বকবিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্ট্রুগা কবিতা সম্মেলনে গিয়ে তিনি সমকালীন বিশ্বকবিদের একাংশের সঙ্গে মিশতে মিশতে তাদেরকে নিয়ে কবিতা লিখে বসেন; কিংবা দূরদেশে ভ্রমণে গিয়ে এক কালো কাঠবিড়ালিকে পিকাসোর মূর্তির উপর বসে পড়তে দেখে স্মরণ করেন ইয়েট্সকে। এই নিয়ে তিনি লেখেন অ্যাবসার্ড ভাবনার এক অন্যরকম এক কবিতা (‘প্রিন্সটনে কালো এক কাঠবিড়ালি’)। নব্বুই-অতিক্রমী তরুণ কবি আবুল হেসেনের এই হচ্ছে মৃত্যু-অতিক্রমী বদল প্রবণতা। আর মৃত্যু বরাবরই তার চেতনায় সত্তার এক স্বাভাবিক বিবর্তন। আলো থেকে আঁধার নয়, বরং এক আলো থেকে অন্য এক আলোতে প্রত্যাবর্তন। ‘মানুষের আলো নিভে গেলে/ কী থাকে? আঁধার?/ নাকি আরও এক আলো?’ কবির পক্ষপাত সেই অন্য এক আলোর দিকে। তবে আরেক সহজাত সত্য হচ্ছে সত্তাবদলের মুহূর্তে উদ্গত দুর্জ্ঞেয় এক অশ্র“বিন্দু। ‘তবু কী আশ্চর্য এই / দুর্জ্ঞেয় পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময়/ যার চোখে পানি টলমল/ করেনি এমন মানুষ কি কেউ/ কোনদিন দেখেছে কোথাও?’ না, দেখিনি আমরাও। তাই আমাদের কালের এই প্রায়-নীরব প্রায়-নিঃসঙ্গ কবি-বিটপীর প্রতি উত্তর প্রজন্মের বিনম্র শ্রদ্ধাশ্রু।

No comments

Powered by Blogger.