সুষমারা ঢাকা সফর- বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় জনগণই মেটাবে by রাহীদ এজাজ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টিকে ‘বিশেষ গুরুত্ব’ দিচ্ছেন। নয়াদিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলে দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্কে ছেদ পড়বে না বরং তা জোরদার হবে। ঢাকা সফরে আওয়ামী লীগ সরকারকে এ আশ্বাসই দিয়ে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে সুষমা স্বরাজ অনেক অস্পষ্টতা দূর করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সুষমা স্বরাজ এটা বলে তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ককে গুরুত্ব দেবে বিজেপি সরকার। তাই আগামী দিনে সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে আগ্রহী তাঁরা। আবার বিএনপির নেত্রীকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এ দেশের জনগণই মেটাবে, ভারত নয়। ক্ষমতায় যে দলেই আসুক তার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেবে নয়াদিল্লি। ভারতে ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে যে অস্বস্তি রয়েছে, সুষমার কথায় সেটা দূর করার ইঙ্গিত ছিল। ২৫ জুন রাতে এসে ২৭ জুন দুপুরে ঢাকা ত্যাগ করেন সুষমা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতকে তার নিজের স্বার্থেই প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলতে হবে। অতীতে কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক যেমন ছিল, তেমনটা থাকবে—এটাও বলতে হবে। বাংলাদেশে সুশাসনের সমস্যাটি দূর করার ব্যাপারেও তাগিদ থাকবে। ভারত নিজের স্বার্থেই তার প্রতিবেশী দেশে গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা দেখতে চাইবে। তবে আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজন অব্যাহত থাকলে ভারত সরকার বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।’
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল বাস্তবায়নে বিজেপি সরকারকে উদ্যোগ নিতে সুষমা স্বরাজকে অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বৃহস্পতিবার একান্ত আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে আসে। বিগত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল বাস্তবায়নে ভারতের রাজ্যসভায় সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব এনেছিল। সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল বিজেপি। এবারের নির্বাচনে বিজেপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করায় খুব সহজেই প্রস্তাবটি পাস করতে পারে। কংগ্রেস যেহেতু প্রস্তাবটি তুলেছে, দলটি অন্তত এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে না, এমনটা বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে।
এ আলোচনার প্রেক্ষাপটে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিজেপি মাত্র ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টিকে মাথায় রেখে বিজেপি সরকার বিষয়গুলো সুরাহায় সচেষ্ট রয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া গুছিয়ে নিতে একটু সময় দরকার। শুধু সীমান্ত নয়, তিস্তার সমস্যাও তাড়াতাড়ি মিটে যাবে। এ জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। দ্রুত তিস্তা চুক্তি সই করার ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজি করানোর ব্যাপারে আশাবাদী সুষমা স্বরাজ।
দুই দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎটি ছিল একেবারেই আনুষ্ঠানিক। এই সাক্ষাৎটিকে কিছুটা যান্ত্রিক মনে হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়ার পর ও বিদায় নেওয়ার সময়তো বটেই পুরো সময়জুড়েই শেখ হাসিনাকে অন্তরঙ্গ ও ঘরোয়া মনে হয়েছে সুষমা স্বরাজের। হাত ধরলেন, উপহার তুলে ধরলেন, কথা বললেন আর আলিঙ্গন করলেন—সবখানেই ছিল আবেগের ছোঁয়া। আর খালেদা জিয়াকে তাঁর মনে হয়েছে আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে ঢাকা।
সুষমা স্বরাজের সফরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ঢাকায় কর্মরত একাধিক কূটনীতিক প্রথম আলোকে জানান, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই ইত্যাদি বিষয় সৌজন্য সাক্ষাতে বারবার উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। এটি সুষমা স্বরাজ ভালোভাবে নেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এ প্রতিবেদককে বলেন, সুষমা স্বরাজের মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো আলামত তাঁরা পাননি। তিনি জানান, সুষমা তাঁদের বলেছেন, বিশেষ কোনো দল নয়, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে আগ্রহী ভারত।
শুক্রবার দুপুরে ঢাকা ছাড়ার আগে সুষমা স্বরাজ বিমানবন্দরে বসে ভারতীয় কূটনীতিকদের কাছে জানতে চান, গণমাধ্যমকে কী জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। যখন তাঁকে জানানো হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত ইত্যাদি বিষয়ের কথা বিএনপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে। তখন সুষমা স্বরাজ প্রশ্ন করেন, তিনি যা বলেছেন সেসব বলা হলো না কেন? সৌজন্য সাক্ষাতের সময় সুষমা স্বরাজ খুব স্পষ্ট করেই খালেদা জিয়াকে জানিয়েছেন, দুই দেশের জনগণের সম্পর্ক নিবিড় হোক, সেটা ভারত সরকার চায়। বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক থাকবে। বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতা আসুক, তার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দেবে ভারত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বাংলাদেশের লোকজনকেই মেটাতে হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়গুলোও গণমাধ্যমে জানানো উচিত ছিল বলে মনে করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ মুহূর্তে মূল নিয়ামক হওয়ায় তাদের পরামর্শে দুই দেশের সম্পর্কে ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখাটাই শ্রেয় বিবেচনা করবে বিজেপি সরকার। সাম্প্রতিককালে দুই প্রতিবেশীর সুসম্পর্কের কারণে ভারত কতটা লাভবান হয়েছে, সেটা তাদের জানা আছে। তাই সম্পর্কে নতুন করে অস্বস্তি তৈরি করতে চাইবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও সুষমা স্বরাজ যথেষ্ট ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়নের মতো অমীমাংসিত বিষয়গুলো তুলেছে, তিনি সেটার প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশ আলোচনার শুরুতেই এ দুটি প্রসঙ্গ তোলেনি। সেই সঙ্গে এ বিষয়গুলো যখন আলোচনায় তুলেছে, তখন আবার এটি বলেনি যে, এগুলোর সুরাহা না হলে সম্পর্ক এগোবে না। বরং বাংলাদেশ বিষয়গুলো পরে তুললেও বেশ যৌক্তিকভাবে নিজেদের দাবি উপস্থাপন করেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ এটাও বলেছে, দুই দেশের স্বার্থে সম্পর্কোন্নয়ন জরুরি।

No comments

Powered by Blogger.